ইউপি নির্বাচনে ‘পরাজয় মানতে না পেরে’ চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা, দাবি স্ত্রীর

নিহত ইউপি চেয়ারম্যান মো. জাফর ইকবাল মানিক
ছবি: সংগৃহীত

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা মির্জারচরে আধিপত্য বিস্তারের জন্যই পরিকল্পিতভাবে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জাফর ইকবালকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার। গত দুটি ইউপি নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাবা-ছেলেকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলনের ব্যবসা ও গ্রাম রক্ষা বাঁধ নির্মাণ নিয়েও প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব ছিল। এ সব ঘটনার জেরেই জনপ্রিয় এই চেয়ারম্যান খুন হন বলে পরিবারের দাবি।

গতকাল শনিবার বিকেল ৪টার দিকে রায়পুরার মির্জারচর ইউনিয়নের শান্তিপুর বাজার এলাকার দুর্বৃত্তের গুলিতে বিদ্ধ হন চেয়ারম্যান জাফর। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ইউপি চেয়ারম্যানের পাশাপাশি জাফর ইকবাল মির্জারচর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মির্জারচর ইউনিয়নে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জেলা পুলিশ লাইনস ও রায়পুরা থানা থেকে যাওয়া অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

আরও পড়ুন

নিহত চেয়ারম্যানের স্ত্রী মাহফুজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূর্বশত্রুতার জেরে ও আধিপত্য বিস্তারের জন্যই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ফিরোজ মিয়ার নির্দেশে তাঁর কর্মী দুলাল নামের এক ব্যক্তি আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। এলাকায় দুলাল সব সময় পিস্তল নিয়ে ঘোরেন। ইউপি নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গত ছয় থেকে সাত বছর ধরে আমার স্বামীর সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব ছিল।’

মির্জারচরের স্থানীয় অন্তত ১০ জন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। তাঁরা বলেন, ২০১৫ সালে মির্জারচর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মিয়ার ছেলে মো. ফারুকুল ইসলাম। ওই নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. জাফর ইকবাল। এর পরের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ফিরোজ মিয়া নিজেই। তিনিও জাফর ইকবালের সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে হেরে যান। এরপর থেকে তাঁরা দুজন স্থানীয়ভাবে প্রতিপক্ষ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

স্থানীয় লোকজন আরও জানান, গত বছরের নভেম্বরে ইউপি নির্বাচনে পরাজয়ের পর সংঘর্ষ হলে ফিরোজ মিয়ার শতাধিক কর্মী-সমর্থক এলাকা ছাড়া হন। এরপর থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত তারা এলাকার বাইরে ছিলেন। গত শুক্রবার এই বিষয়ের মীমাংসার জন্য এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে দুই পক্ষ আলোচনায় বসে। তাৎক্ষণিক সমাধান না হওয়ায় পরবর্তী শুক্রবার আবার বসার তারিখ নির্ধারণ করে ফিরোজ মিয়ার কর্মী-সমর্থকেরা সভা ছেড়ে চলে যায়। পরদিন শনিবার বিকেলে শান্তিপুর বাজারের স্কুলমাঠসংলগ্ন স্থানে চেয়ারম্যান জাফর ইকবালকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া নিয়ে যখন কর্মী-সমর্থকেরা ব্যস্ত ছিলেন তখন ফিরোজ মিয়ার এলাকাছাড়া অনুসারীরা যার যার বাড়িতে উঠে পড়েন।

মির্জারচর ইউনিয়নে গত দেড় বছরে আধিপত্য বিস্তারের জেরে ইউপি চেয়ারম্যান জাফরসহ অন্তত সাতজন খুন হলেন। এর মধ্যে চারজন ওই এলাকার আর তিনজন ভাড়াটে হয়ে মারামারি করতে এসেছিলেন।

নিহত চেয়ারম্যানের স্ত্রীর অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ফিরোজ মিয়ার মুঠোফোনে গতকাল সন্ধ্যা থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত অন্তত ২০ বার ফোন দেওয়া হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। দুলাল নামে যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুলি ছোড়ার অভিযোগ তুলেছেন নিহত জাফরের স্ত্রী, তাঁকেও মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইমান উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘দিনদুপুরে একজন জনপ্রতিনিধিকে এভাবে গুলি করে হত্যার বিষয়টি আমাদের স্থানীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও দুর্বলতাই প্রকাশ করে। এই ঘটনায় আমাদের কোনো পক্ষের যদি ইন্ধন থাকে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা দলীয় ব্যবস্থা নেব।’

নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত তিনজনকে এরই মধ্যে শনাক্ত করতে পেরেছি আমরা। তাঁদের গ্রেপ্তারের স্বার্থে এখনই নাম-পরিচয় আমরা প্রকাশ করতে চাইছি না। আশা করছি, তাঁদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে পারব। ময়নাতদন্তের পর নিহত ব্যক্তির লাশ দাফন শেষে স্বজনেরা থানায় মামলা করতে আসবেন।’