ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত

চলছে তীব্র গরম। এই গরম থেকে স্বস্তি পেতে ফুটপাতের দোকান থেকে সরবত খাচ্ছেন এক ব্যক্তি। আজ সোমবার গাজীপুরের সফিপুর বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে বিদ্যুতের অব্যাহত ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে শিল্পমালিকেরা সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। এসব কারণে লোকসান ও বায়ার হারানোর শঙ্কায় শিল্পমালিকেরা।

এদিকে জেলার প্রত্যন্ত পল্লি অঞ্চলেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং বৃদ্ধির কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তাদের দাবি, গাজীপুরে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। ফলে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, শিল্পকারখানা অধ্যুষিত গাজীপুরে ১৫৫টি ফিডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো হয়। এর মধ্যে ১০০টি ফিডারে শিল্পকারখানা রয়েছে। বাকিগুলো আবাসিক। জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৬০০ থেকে ৬৫০ মেগাওয়াট। গরম বেড়ে গেলে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। তার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় অর্ধেকর কম বিদ্যুৎ। শিল্পকারখানায় লোডশেডিং না করার জন্য সরকারের নির্দেশনা থাকলেও বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে তা পুরোপুরি মানা সম্ভব হচ্ছে না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দফায় দফায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

বিভিন্ন শিল্পকারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিল্প এলাকা হিসেবে গাজীপুরে লোডশেডিং কম হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টো। এমনকি শিডিউল মেনে ও আগাম তথ্য দিয়ে লোডশেডিং করার সরকারের ঘোষণাও মানা হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিভিন্ন কারখানায় চালু রেখে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, আবার উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এসব কারণে ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান এবং বায়ার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।

গাজীপুর মহানগরীর নাওজোড় এলাকার তোহা ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার মহাব্যবস্থাপক কবিরুল হাসান বলেন, তাঁদের কারখানায় দেড় হাজার শ্রমিক রয়েছেন। কারখানা প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা চালু থাকে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। ফলে কারখানা চালু রাখার জন্য ডিজেলের মাধ্যমে জেনারেটর চালু রাখতে হয়।
তিনি আরও বলেন, আগে যেখানে মাসে ১৫ লাখ টাকার ডিজেলে লোডশেডিং মোকাবিলা করা গেছে, সেখানে এখন মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ডিজেল দিয়ে কারখানা সচল রাখতে হচ্ছে। অর্থাৎ এ কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদন বাড়েনি।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সাদমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সহসভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘বিদ্যুৎ-সংকটে কারখানা চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা দিনে কারখানায় গড়ে ৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পাই। বাকি সময় উচ্চ মূল্যের জ্বালানি তেল দিয়ে জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখতে হয়। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আগে যেখানে এক দিনে ৩০ মেট্রিকটন পণ্য উৎপাদন হতো, সেখানে এখন হচ্ছে ১৫-১৬ মেট্রিকটন। এসব কারণে আমরা বিদেশি বায়ারদের কাছে সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারছি না। কিন্তু মাস শেষ হলেই ব্যাংকের টাকা, কর্মীর বেতনসহ সবকিছুই সময়মতো দিতে হচ্ছে।’


তিনি আরও বলেন, ‘পল্লী বিদ্যুৎ দিয়ে আসলে এ দেশের শিল্প রক্ষা হবে না। আমরা কোনোভাবেই আমাদের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ধরে রাখতে পারছি না। আমাদের বাণিজ্যিকভাবে এক ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে ১৩ টাকার মতো খরচ হয়। আর জেনারেটর দিয়ে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের ৪০ টাকার বেশি খরচ হয়। ফলে ক্যাপাসিটি অনুযায়ী কোনো কোনো কারখানার খরচ ৫ লাখ থেকে দৈনিক ১০ লাখ টাকারও তেল বাবদ ব্যয় করতে হয়। এই বিপুল ক্ষতি মেনে নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ-সংকটে কারখানার প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে শ্রমিক-মালিক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, দিনে-রাতে সমানে বিদ্যুৎ থাকছে না। দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। রাতেও একই অবস্থা। বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করা হলে তা বলেছেন, কিছুই নাকি করার নেই।

কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, সফিপুর গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। সেখানে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যবস্থা বাণিজ্য যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি গরমে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
গাজীপুর পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা জানান, জেলায় বিদ্যুতের মোট চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫০ মেগাওয়াট। টঙ্গী এলাকায় ডেসকো ও কালিয়াকৈর এলাকায় ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। আর বাকি এলাকায় গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। জাতীয় গ্রিড থেকে সরাসরি লোড ম্যানেজমেন্ট করা হয়। ফলে গ্রাহক জানতে পারছেন না কোন এলাকায় কখন লোডশেডিং হবে।