ছয় বছরে এক কিলোমিটার অংশের কাজও শেষ হয়নি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর-আশুগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের নির্মাণকাজ ছয় বছরেও শেষ হয়নি। একাধিক সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও ২০ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ এখনো শুরুই হয়নি। সম্প্রতি আশুগঞ্জ উপজেলার চরচারতলার বিল এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

ছয় বছরেও তেমন অগ্রগতি হয়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর-আশুগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের নির্মাণকাজের। এর মধ্যে তিন দফায় প্রকল্পের সময় বেড়েছে চার বছর, বাড়ানো হয়েছে ব্যয়ও। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঠিকাদারের গাফিলতি, প্রকল্পের ভুলসহ চার কারণে মহাসড়কে নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ভাষ্য, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, ঠিকাদারের ভুলে সময়মতো কাজ শুরু করতে না পারা, ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণে বিশেষজ্ঞদের ভুল ও প্রকল্পপ্রস্তাব সংশোধনের কারণে আঞ্চলিক মহাসড়কটির নির্মাণকাজ একপ্রকার থমকে আছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৪ কোটি টাকা। প্রকল্পে ৯টি সেতু ও ১৩টি কালভার্ট ধরা আছে। নয়টি সেতুর মধ্যে দুটি বড়সহ আটটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ের সঙ্গে জায়গা নিয়ে জটিলতা থাকায় একটি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় ২০ কিলোমিটার সড়কের ১ কিলোমিটারও আমরা নির্মাণ করতে পারিনি।’

সড়কটির মাধ্যমে আশুগঞ্জের সঙ্গে জেলা সদর, আশুগঞ্জসহ সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বর্তমানে নবীনগর থেকে ঢাকাসহ বা অন্য কোনো শহরে যাতায়াতে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা অথবা পার্শ্ববর্তী বাঞ্ছারামপুর উপজেলা ঘুরে নারায়ণগঞ্জের ভুলতা-ধনবাড়িয়া হয়ে যেতে হয়। এতে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ ঘুরতে হয়। আবার নবীনগর থেকে জেলা সদরে যাতায়াতে স্পিডবোট বা পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে যেতে হয়।

নবীনগরের মানুষদের দুর্ভোগ লাঘবে এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত নবীনগর-আশুগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন হয়। ১৯ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ দশমিক ৩ ফুট প্রস্তের সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ জুলাই। ২০২১ সালের জুন মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনুমোদিত প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ না থাকা, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা, প্রকল্প প্রণয়ন কমিটির বিশেষজ্ঞদের ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণে ভুল, ঠিকাদারের সময়মতো কাজ শুরু করতে না পারা ও প্রকল্প সংশোধনের কারণে কাজ শুরু করা যায়নি।

প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪২১ কোটি টাকা। পরে ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা নিরসনে ব্যয় ৪৩ দশমিক ৫২ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাড়িয়ে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। সর্বশেষ ৬০৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তৃতীয় দফায় প্রকল্পে বরাদ্দের অর্থ ও সময় দুটিই বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি নবীনগর উপজেলার নবীনগর পাগলা নদী, বীরগাঁও, আমতলী, গাজিরকান্দি, কিশোরপুর, পশ্চিম কিশোরপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায় সড়কের কোনো কাজ হয়নি। তবে ৯টি সেতু ও ১৩টি কালভার্টের অধিকাংশেরই কাজ শেষ। নদী ও বিলের ওপর নির্মিত সেতু-কালভার্ট থাকলেও নেই কোনো সংযোগ সড়ক। নবীনগরে সেতু ও কালভার্টের পাশের উঁচু-নিচু ও সরু রাস্তায় মোটরসাইকেলই যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। তবে বেশির ভাগ মানুষ হেঁটে চলাচল করেন।

থোল্লাকান্দির মতিউর রহমান, আবদুল লতিফ ও ফেরদৌস মিয়া বলেন, কয়েক বছর ধরে সেতু ও কালভার্ট পড়ে রয়েছে। কিন্তু সড়ক নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। তবে নির্মাণ করা কালভার্টের উচ্চতা অনেক কম। বর্ষাকালে এসবের নিচ দিয়ে নৌকার চলাচল ব্যাহত হবে।

আঞ্চলিক এই মহাসড়কের জন্য ৮৬ দশমিক ৩৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ২৯৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। তবে ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত ঘটনায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সাতটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা শেষ হয়েছে, ফলে ভূমি অধিগ্রহণও শেষ হয়নি। এসব জটিলতা শেষে কবে নাগাদ সেতুর কাজ শেষ হবে, তা বলতে পারছেন না কেউই।

নবীনগর উপজেলার বড়িকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার পারভেজ বলেন, সড়কটি নির্মিত হলে দুই উপজেলার মানুষের কষ্টের ইতি ঘটবে। যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় গর্ভবতী, অসুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। রাতের বেলা কেউ অসুস্থ হলে কিংবা জরুরি প্রয়োজনে জেলায় যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

প্রকল্পটির দীর্ঘসূত্রতার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন। তিনি জানান, আঞ্চলিক মহাসড়কটি নির্মাণের জন্য যেসব অংশে কাজ করার সুযোগ ছিল, সেখানে যথাসময়ে কাজ শুরু করতে পারেননি নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদার। পরে কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সময় বাড়ানোর আবেদন না করায় ঠিকাদারের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘নতুনভাবে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুই–এক মাসের মধ্যে নতুন ঠিকাদার পেলে কাজটি দ্রুতই শুরু হবে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগছে। এখনো ভূমি অধিগ্রহণ চলছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সড়ক নির্মাণের জন্য যতটুকু ভূমি প্রয়োজন ছিল, আমাদের বিশেষজ্ঞরা সেখানে সেই পরিমাণে ভুল করেছে।’