দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রতিবছর পর্যটক বেড়েই চলছে, তবে সুযোগ-সুবিধা তেমন বাড়েনি। কক্সবাজার শহরে খাবারের মূল্য, পরিবহনের ভাড়া—সবকিছুই লাগামহীন, রয়েছে নিরাপত্তাঝুঁকিও। শহরজুড়ে যানজটের পাশাপাশি এখন সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যায় সড়ক। আগে সমুদ্রসৈকতে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো, তা–ও এখন বন্ধ।
পর্যটন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পর্যটকদের বেশির ভাগই আসেন কেবল সাগরের টানে। সাগরের নোনাজলে গোসল আর বালুচরে সূর্যাস্ত দেখেই তাঁদের সময় কাটে। পর্যটকদের কিছু অংশ দিনে দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ সড়ক, টেকনাফ সীমান্ত, রামুর বৌদ্ধপল্লি, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, মহেশখালীসহ নানা এলাকা ঘুরে বেড়ান। তবে সন্ধ্যার পর শহরে ফিরে এসে অলস সময় কাটে তাঁদের। আগে হিমছড়ি ঝরনা, দরিয়ানগর পর্যটনপল্লির শাহেনশাহ গুহা, উখিয়ার কানারাজার গুহা ও টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের কুদুম গুহার প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ থাকলেও এখন সেখানে বেড়ানোর মতো পরিবেশ নেই। পর্যটকদের কাছে প্রিয় এসব স্থান অযত্নে-অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ২০২৩ সালে অন্তত ৬০ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে এসেছেন। ২০২৪ সালে এসেছেন ৭০ লাখ, এ বছর তা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। বছরে ১০ লাখ করে পর্যটক বাড়লেও তাঁদের জন্য বিনোদনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না, সুযোগ-সুবিধাও বাড়ছে না।
আবুল কাশেম সিকদার বলেন, আগে সমুদ্রসৈকতে বালুর ভাস্কর্য মেলা, ঘুড়ি উৎসব, বিচ কার্নিভ্যাল, কনসার্ট, বিচ ফুটবল, বিচ ভলিবল, সার্ফিং প্রতিযোগিতা, বর্ষবরণ ও বিদায়ের অনুষ্ঠানসহ নানা উৎসবের আয়োজন করা হতো। নিরাপত্তার অজুহাতে এক দশক ধরে সবকিছু বন্ধ রয়েছে। পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস-রিসোর্টের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি তারকা হোটেল ও রিসোর্ট বছরে এক-দুবার করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তা–ও নিজেদের অতিথিদের জন্য।
আগে সমুদ্রসৈকতে বালুর ভাস্কর্য মেলা, ঘুড়ি উৎসব, বিচ কার্নিভ্যাল, কনসার্ট, বিচ ফুটবল, বিচ ভলিবল, সার্ফিং প্রতিযোগিতা, বর্ষবরণ ও বিদায়ের অনুষ্ঠানসহ নানা উৎসবের আয়োজন করা হতো। নিরাপত্তার অজুহাতে এক দশক ধরে সবকিছু বন্ধ রয়েছে।
কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১১৫ কিলোমিটার সৈকত কয়েক দশক ধরে অরক্ষিত পড়ে রয়েছে জানিয়ে আবুল কাশেম বলেন, সন্ধ্যার পর মেরিন ড্রাইভে পর্যটক ভ্রমণ অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। মেরিন ড্রাইভের পাশে ১০ থেকে ১২টি স্থানে নতুন বিনোদনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে শহরের ওপর চাপ কিছু কমত।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারে বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ পর্যটকের বিপরীতে পর্যটন–সংশ্লিষ্ট ১৭টি খাতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এরপরও পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। বিনোদনকেন্দ্রগুলোও সংস্কারের অভাবে শ্রীহীন হয়ে পড়ছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান মো. সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিনোদনের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে সৈকতজুড়ে কেব্ল কার, অ্যাকুয়ারিয়ামসহ নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।
সৈকতে মৃত্যু ফাঁদ, গোসলে ঝুঁকি
গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে নেমে দেখা যায়, এক কিলোমিটারে জড়ো হয়েছেন অন্তত ২০ হাজার মানুষ। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের কলাতলী, সিগাল, লাবণি পয়েন্টের ৩ কিলোমিটারে আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে এই ৫ কিলোমিটারে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ গোসলে নামলেও সেখানে সাগরের পানিতে লুকিয়ে থাকা ১০ থেকে ১২টি গুপ্তখালের প্রতি কারও নজর নেই। সেখানে গোসলে নামতে নিষেধ করে একাধিক লাল নিশানা উড়ানো হলেও, কেউ তা মানছেন না। লাল নিশানার পাশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গোসলে নামেন ঢাকার ফকিরাপুল এলাকার দুই কলেজছাত্র শিহার ও আবরাম। জানতে চাইলে দুজনের উত্তর, ‘লাল নিশানা দেখেছি, কিন্তু আশপাশে যে গুপ্তখাল আছে, তা জানি না।’
এক দশক আগেও পর্যটকেরা হিমছড়ির ঝরনা, শাহেনশাহ গুহা, কানারাজার সুড়ঙ্গ ও কুদুম গুহা দেখতে কক্সবাজারে আসা মানুষজন ছুটে যেতেন। এখন বিনোদনকেন্দ্রগুলোর অবস্থা বেহাল। সংস্কারের অভাবে কেন্দ্রগুলো যেমন ধ্বংস হচ্ছে, নিরাপত্তাব্যবস্থাও নেই।
পর্যটকদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সি-সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহ বলেন, পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে লাখো পর্যটকের নিরাপত্তায় ২৭ জন লাইফগার্ড থাকলেও অবশিষ্ট ১১৫ কিলোমিটার সৈকতে কেউ নেই। তহবিলসংকটের কারণে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে লাইফগার্ডের সেবাও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন পর্যটকের নিরাপত্তাঝুঁকি আরও বাড়বে।
সি-সেফ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউটের আর্থিক সহায়তায় ২০১২ সাল থেকে সি-সেফ লাইফগার্ড সৈকতে সেবা দিয়ে আসছে। গত ১২ বছরে লাইফগার্ডের কর্মীরা ৮২৩ জন পর্যটককে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী। একই সময় গুপ্তখালে আটকে কিংবা স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে নিহত ৬৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)–এর কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন সৈকতে পর্যটকদের নিরাপদ গোসলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে, যেন গোসলে নেমে হিংস্র প্রাণীর আক্রমণের শিকার না হন, কিংবা স্রোতের টানে গভীর সাগরে ভেসে না যান। কিন্তু কক্সবাজারে এত আন্দোলন-সংগ্রামের পরও নিরাপদে গোসলের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এর একমাত্র কারণ সদিচ্ছার অভাব। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে সুগন্ধা, কলাতলী, সিগাল ও লাবণি পয়েন্টে গোসলে নেমে ১৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভেসে যাওয়া পর্যটকদের উদ্ধারে হেলিকপ্টার দূরের কথা, একজন ডুবুরিও নেই। জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য পুরো সৈকতে নেই কোনো চিকিৎসক।
বেহাল পর্যটনকেন্দ্র, পরিবহনে নৈরাজ্য
পর্যটন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক আগেও পর্যটকেরা হিমছড়ির ঝরনা, শাহেনশাহ গুহা, কানারাজার সুড়ঙ্গ ও কুদুম গুহা দেখতে কক্সবাজারে আসা মানুষজন ছুটে যেতেন। এখন বিনোদনকেন্দ্রগুলোর অবস্থা বেহাল। সংস্কারের অভাবে কেন্দ্রগুলো যেমন ধ্বংস হচ্ছে, নিরাপত্তাব্যবস্থাও নেই। হিমছড়ির ঝরনাতে পানি নেই। যেটুকু পানি পড়ে, তাতে মানুষ হতাশ। দরিয়ানগর ও হিমছড়ি পয়েন্টে চারটি প্যারাসেইলিং প্রতিষ্ঠান থাকলেও অদক্ষ চালকের কারণে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। সৈকত তীরের ঝাউবাগানে ঢুকলে পর্যটকেরা ছিনতাইয়ের শিকার হন। বাগানের ভেতরে হাজারো অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সেখানে বখাটে, ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের আড্ডা চলে।
রাজশাহী ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাজেদুর রহমান ও শফিকুর রহমান বলেন, পুরো শহরটা এখন ইটপাথরের ঘিঞ্জি-বস্তিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়া কিছুই নেই। পরিবহন খরচও অনেক বেশি। ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করেন চালকেরা।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যাতায়াতে ১২ জন ধারণক্ষমতার একটি খোলা জিপ ভাড়া নিলে গুনতে হয় (আসা যাওয়া) ৬ হাজার ৫০০ থেকে ৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া ইনানী-পাটোয়ারটেক সৈকতে যেতে ৩ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা এবং হিমছড়ি যেতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা লাগে।
কক্সবাজার জিপ-মাইক্রো মালিক সমিতির সভাপতি শাহজাহান বাপ্পী জানান, শহরে পর্যটক টানার জিপগাড়ি (চান্দেরগাড়ি) আছে ৪১০টি, মাইক্রো-হাইয়েস ২৪০টি আর ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-টমটম, অটোরিকশা, সিএনজিচালিত ইজিবাইক আছে আরও ৭ হাজারের বেশি। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল আছে চার শতাধিক।
কয়েকজন জিপ ও মাইক্রোবাসের চালক জানান, অধিকাংশ টমটম ও অটোরিকশাচালকেরা অপ্রাপ্তবয়স্ক। মেরিন ড্রাইভে বেপরোয়া গতিতে টমটম ও মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। নিরাপত্তার কারণে মেরিন ড্রাইভে সন্ধ্যা সাতটার পর পর্যটকবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
১২ দিনে ৯ লাখ পর্যটক
হোটেলমালিকেরা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে কক্সবাজারে পর্যটক আসতে শুরু করেছেন। আগামী ৮ অক্টোবর পর্যন্ত ১২ দিনের ছুটিতে অন্তত ৯ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত চার দিনে (দুর্গাপূজার ছুটিতে) আসছেন অন্তত পাঁচ লাখ পর্যটক।
কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, তারকা মানের হোটেল-রিসোর্টগুলোতে এখন কোনো কক্ষ খালি নেই। মাঝারি মানের গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯০ শতাংশ কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে। গত বছর কক্ষভাড়ার বিপরীতে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হলেও এবার তেমন কিছু নেই। তবে কিছু হোটেল-রিসোর্ট গেস্টহাউস নিজেদের উদ্যোগে ছাড় দিচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মুকিম খান বলেন, কতিপয় অসাধু হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কক্ষভাড়া ও বাড়তি খাবারের দাম আদায় করছেন, এমন অভিযোগ আছে। জেলার প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিলেও এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর শহরের প্রধান সড়ক অন্ধকারে ডুবে থাকে। তখন চুরি-ছিনতাই হয়। শহরের সিসি ক্যামেরাগুলো অচল পড়ে আছে। সৈকতজুড়ে ভিক্ষুক ও পথশিশুদের উৎপাত-দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে বিরক্তি ও দুর্ভোগের কারণ অনেক পর্যটক সৈকতে নামতে অনীহা প্রকাশ করেন।