নিভৃত গ্রামে আলোঝলমলে সন্ধ্যা, প্রদর্শিত হলো মঞ্চনাটক ‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’

‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’ নাটকের অংশ। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামের মণিপুরি থিয়েটারের নটমণ্ডপেছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের ঘোড়ামারায় বিকেল পেরিয়ে তখন সন্ধ্যা নামছে। নিভৃত গ্রামটিতে এই হেমন্তে হয়তো ও রকমই শান্ত, ধীর সন্ধ্যা নামে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/ সন্ধ্যা আসে;...পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;...।’ অন্যদিন গ্রামটি অতটা রঙে ঝিলমিল হয় কি না, জানা নেই। তবে গতকাল শনিবারের বিকেল ও সন্ধ্যাটা ‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’ মঞ্চনাটককে ঘিরে ঝিলমিল করে উঠেছিল গ্রামটি।

ঘোড়ামারা কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম। গতকাল মণিপুরি থিয়েটারের নটমণ্ডপে ছিল ‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’ নাটকের শেষ প্রদর্শনী। গত বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) প্রথম প্রদর্শনী দিয়ে শুরু হয়। গতকাল সন্ধ্যায় শেষ হয়েছে শীতকালীন প্রদর্শনীটি। তিন দিনে পাঁচটি প্রদর্শনীর প্রতিটিই গ্রামের মানুষ টিকিট কেটে দেখেছেন, এসেছেন দূরদূরান্তের দর্শকেরাও।

গতকাল বিকেলে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা গেছে, নটমণ্ডপের কাছে অনেক দর্শক এসে জড়ো হয়েছেন। বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুরা দল বেঁধে, কেউ সপরিবার, কেউ একা নটমণ্ডপে এসে ভিড় করেন। অনেকে এসেছেন অন্য কোনো শহর থেকে, অন্য কোনো গ্রাম থেকে। কেউ খড়ের ছাউনি দেওয়া অস্থায়ী কাউন্টার থেকে প্রদর্শনীর আগে টিকিট কেটে নিচ্ছেন। কেউ নটমণ্ডপের সামনে, কেউ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছেন। কেউ গ্রামীণ পথের ধারে বেঞ্চে বসে নাটক শুরুর অপেক্ষা করছেন। মঞ্চনাটক প্রদর্শনী উপলক্ষে অস্থায়ী চা, পেঁয়াজু, ফুলকপি ও আলুভাজার দোকান বসেছে। লোকে লাইন ধরে এসব কিনছেন, খাচ্ছেন।

হঠাৎ দেখা হয় লোকগবেষক আহমদ সিরাজের সঙ্গে। লেখালেখির মানুষ, নাটক দেখতে এসেছেন। নাটক দেখতে এসেছেন মৌলভীবাজারের রেডিও পল্লীকণ্ঠের স্টেশন ম্যানেজার মেহেদি হাসান ও একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা হাসান তারেক। তাঁরা দুজনই নাটকের মানুষ, নাটকের খোঁজে ঘুরে বেড়ান। ব্যস্ততার মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করছেন শুভাশিস সিনহা—কবি ও নাট্যকার। স্মৃতিকুমার সিংহের ‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’ গল্পটির নাট্যরূপ ও নির্দেশনা তাঁরই।

নটমণ্ডপের সামনে দর্শকেরা
ছবি: প্রথম আলো

দেখতে দেখতে শেষ দিনের প্রথম প্রদর্শনীর সময় চলে আসে। নটমণ্ডপে ঘণ্টা বেজে ওঠে, বন্ধ দরজা খুলে যায়। সারি বেঁধে লোকজন নাটক দেখতে হলে প্রবেশ করেন। সুশৃঙ্খলভাবে যে যাঁর আসনে বসে পড়েন। মঞ্চে আলো ফুটে ওঠে, শুরু হয় ধ্বজো মেস্তরীর বয়ান। ধ্বজো মেস্তরীর যাপিত জীবনের দিকে আকর্ষিত হন দর্শকেরা। টানা ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের এই নাটকটিতে অতীত, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অগ্রগতির একচোখা বর্তমানের মধ্যে চিরকালীন দ্বন্দ্বকেই যেন জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে সামনে আনা হয়েছে। একজন ধ্বজো মেস্তরী অনেক দর্শককেই স্মৃতিকাতর করেছেন। কী ছিল, কী হারিয়েছে, সবকিছু হারানোর কি প্রয়োজন আছে—অনেককে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে এই মঞ্চনাটক।

একটি সাধারণ মঞ্চ। শুধু কাপড় দিয়ে মঞ্চের প্রয়োজনীয় দৃশ্য-চাহিদা মেটানো হয়েছে। দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে নিঃশব্দে বসে ছিলেন নাটকের পুরো সময়। নাটকটি বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার মিশ্রণে তৈরি। পরিচিত নাট্যশিল্পী জ্যোতি সিনহা ছিলেন কথকের ভূমিকায়, ধ্বজো মেস্তরীর জীবনগাথা তিনি তুলে ধরেছেন, অন্যরা ফুটিয়ে তুলেছেন পার্শ্বচরিত্র। নাটকটিতে ধ্বজো মেস্তরীর তৈরি ঘর তাঁর ঐতিহ্য, আবেগ ও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। সেখানে আধুনিকতার ঢেউ আসে, সেই ঘরের চিহ্ন হারিয়ে যায়। নিজের ঘরটিকেও তিনি ধরে রাখতে পারেন না। নতুন ঘর নির্মিত হবে—নিজের সন্তানেরাও বাপ-দাদার আবেগ-ভালোবাসাকে আর ধরে রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রজন্মের ভাব-ভাবনার দূরত্বকে না কমিয়ে উপড়ে ফেলার যে চর্চা, ধ্বজো মেস্তরীরা তাতে শুধু বিধ্বস্ত হন, বিপন্ন হন, অনেকে বিলুপ্ত হন।

দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে নিঃশব্দে বসে ছিলেন নাটকের পুরো সময়
ছবি: প্রথম আলো

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা, সমরজিৎ সিংহ, বিধান সিংহ, স্বর্ণালী সিনহা, শিউলী সিনহা, সুবর্ণা সিনহা, রাজকান্ত সিংহ, দীপ্রাংশু সিংহ, রোহিত সিংহ, সীমান্ত সিংহ, অনন্যা সিনহা ও স্বর্ণালী শর্মা। সংগীতে ছিলেন শর্মিলা সিনহা। বাদ্যে রনি সিংহ ও অঞ্জনা সিনহা। আলোক পরিকল্পনায় আসলাম অরণ্য।

নাটক দেখা শেষে নাট্যকর্মী হাসান তারেক বলেন, ‘নতুন ও পুরোনোর মধ্যে যে চিরকালীন দ্বন্দ্ব, ঘরকে কেন্দ্র করে সেই দ্বন্দ্বটা নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একজন নাট্যকর্মী হিসেবে যে খিদে নিয়ে নাটক দেখতে চাই, নাটকটি সে রকমই দেখেছি। ভালো লেগেছে।’