রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনে মরিয়া স্বপন ও শাহীন

যশোরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুই প্রভাবশালী নেতা স্বপন ভট্টাচার্য্য ও সদস্য শাহীন চাকলাদার। স্বপন ভট্টাচার্য্য সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী এবং যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের দুইবারের সংসদ সদস্য। শাহীন চাকলাদার যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সাবেক সদস্য এবং ২০০৪ সাল থেকে অদ্যাবধি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মাঝে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি টানা তিনবার যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।

এই দুই প্রভাবশালী নেতাই গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। এর পর থেকে তাঁরা নিজ নিজ সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। কিছুদিন তাঁরা চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু চলমান ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে এই দুই নেতাই আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুজনই তাঁদের পছন্দের প্রার্থী দিয়েছেন। তাঁদের বিজয়ী করে দুই উপজেলায় এই পরাজিত দুই সংসদ সদস্য নিজেদের হারানো মাটি ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়েছেন।

আমি পরাজিত হয়ে নেতা-কর্মীদের পাশে ছিলাম। পরাজিত হয়েছিলাম কালোটাকা, কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে। এখনো উপজেলাতে আমার জনপ্রিয়তা রয়েছে, নেতা-কর্মীও রয়েছেন।
স্বপন ভট্টাচার্য্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও যশোর-৫ আসনের দুবারের সংসদ সদস্য

প্রথম ধাপে ৮ মে মনিরামপুর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেনকে সমর্থন দিয়েছিলেন এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ইয়াকুব আলী। স্বপন ভট্টাচার্য্য রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমজাদ হোসেনকে পাল্টা সমর্থন দেন। নির্বাচনে স্বপনের প্রার্থী আমজাদ জয়ী হয়েছেন। ১০ মে বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে নেতা-কর্মীদের সমাগম ঘটিয়ে বিজয় মিছিল ও সমাবেশ করেন স্বপন। বিজয় মিছিলের নামে এটি সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের মধুর প্রতিশোধ এবং স্বপনের শক্তির মহড়া ছিল বলে এলাকায় চাউর হয়েছে।

স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য, উপজেলা পরিষদে নিজের প্রার্থীকে বসানোর মধ্য দিয়ে আবারও মনিরামপুরের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে যাচ্ছেন স্বপন ভট্টাচার্য্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপন ভট্টাচার্য্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পরাজিত হয়ে নেতা-কর্মীদের পাশে ছিলাম। নেতা-কর্মীরাও আমার পাশে ছিলেন। পরাজিত হয়েছিলাম কালোটাকা, কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে। এখনো উপজেলাতে আমার জনপ্রিয়তা রয়েছে, নেতা-কর্মীও রয়েছেন।’

অন্যদিকে, যশোর শহরের রাজনীতির একসময়ের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক শাহীন চাকলাদার ২০২০ সালের জুলাইয়ে যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন। সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে কেশবপুরে সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই সদর উপজেলায় তাঁর একক আধিপত্যে ভাটা পড়তে থাকে। গত সংসদ নির্বাচনে একই আসনে দলীয় মনোনয়ন পান তিনি। কিন্তু নতুন মুখ স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আজিজুল ইসলামের কাছে পরাজিত হয়ে কেশবপুরের রাজনীতিতেও পিছু হটেন শাহীন। পরাজিত হওয়ার পর কেশবপুরে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে শাহীন চাকলাদারকে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। যদিও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে রয়েছেন তিনি। কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থেকে তিনি আবার শহরের রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেছেন।

নিজের রাজনৈতিক মাঠ শক্ত করতে যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চাচাতো ভাই যুবলীগ নেতা তৌহিদ চাকলাদারকে প্রার্থী করেছেন শাহীন। তৃতীয় ধাপে ২৯ মে এই উপজেলার ভোট হবে। বর্তমানে বিভিন্ন ইউনিয়নে তৌহিদ চাকলাদারের পক্ষে গণসংযোগ, পথসভা ও কর্মিসভায় যোগ দিচ্ছেন শাহীন চাকলাদার। অন্যদিকে, যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ এই উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে সমর্থন দিয়েছেন।

দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, সদর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় গোটা জেলার রাজনীতি। সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন কেন্দ্র করে শাহীন চাকলাদার ও সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ আবারও মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। এই উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কাজী নাবিল ও শাহীন চাকলাদারের মধ্যে বিরোধ প্রায় এক দশকের। মূলত যশোর-৩ আসনে দলীয় মনোনয়ন ও আধিপত্য ঘিরেই তাঁদের দুজনের এই দ্বন্দ্ব। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে তাঁরা দুজন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কাজী নাবিল। তখন মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন শাহীনের সমর্থকেরা।

এরপর ২০১৮ সালে আবারও মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন শাহীন চাকলাদার। আবারও মনোনয়ন পান কাজী নাবিল। এতে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। ২০২০ সালে কেশবপুরের সংসদ সদস্য ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হলে উপনির্বাচনে শাহীন চাকলাদার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। তবে গত সংসদ নির্বাচনে কেশবপুরে পরাজিত হন শাহীন। তাই এখন আবারও সদরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে চান জেলা আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে উপজেলা পরিষদে বসাতে চান তাঁরই চাচাতো ভাইকে।

শাহীনের ফিরে আসার এই লড়াইয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলামও তাঁর পাশে আছেন। তবে শাহীনকে ছাড় দিতে চান না তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সংসদ সদস্য নাবিল। তিনিও পাল্টা আনোয়ার হোসেনকে জয়ী করতে কাজ করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহীন চাকলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তৌহিদ চাকলাদের পক্ষে ভোট করছি। বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মিসভায় যোগ দিয়েছি এটা সত্য। মূল কথা হচ্ছে, ভোটের মাঠে ভোটার উঠাতে হবে। যে প্রার্থী সেটা করতে পারবে, সেই বিজয়ী হবে। সদরের রাজনীতি দুর্বল হয়ে গেছে বলে আবার আমাকে মাঠে নামতে হচ্ছে।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি সাড়া দেননি।