মারিয়ামের ভালোবাসার ‘বিড়াল রাজ্য’

বাড়িতে পোষা বিড়ালের সঙ্গে মারিয়াম বিনতে জাহাঙ্গীর। মঙ্গলবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা শহরের পুরাতন হাসপাতালপাড়ায়ছবি: শাহ আলম

বাড়িতে বিড়াল পোষা শখ মারিয়াম বিনতে জাহাঙ্গীরের। সেই শখ থেকে ১৪ বছর ধরে বাড়িতে বিড়াল পুষছেন। বর্তমানে তাঁর বাড়িতে বিড়ালের সংখ্যা ১৫। এসব বিড়াল ঘিরেই তাঁর জীবনযাপন, প্রশান্তি, স্বপ্ন ও ভালোবাসা। তাঁর বসতবাড়িটিই যেন এখন ‘বিড়াল রাজ্য’। বিড়ালগুলো ভালোবেসেই ভবিষ্যতে চলতে চান বলে জানিয়েছেন বেসরকারি কর্মজীবী এই নারী।

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বিশেষ এই দিনে বিড়ালের প্রতি মারিয়ামের অন্য রকম ভালোবাসার গল্পই বলা যাক। চুয়াডাঙ্গা শহরের পুরাতন হাসপাতালপাড়ায় মারিয়ামদের বাড়ি। বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেন ও আনজু আরা বেগম দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মারিয়াম ছোট। মারিয়াম পেশায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব ব্যবস্থাপক। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০২২ সালে চাকরিতে যোগ দেন। মারিয়ামের একমাত্র ভাই ওসামা বিন জাহাঙ্গীর দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ২০১০ সালে স্ত্রী আনজু আরার মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর হোসেন দুই সন্তানকে নিয়ে বাড়িটিতে বসবাস করছেন।

পোষা বিড়ালকে আদর দিচ্ছেন মারিয়াম
ছবি: প্রথম আলো

বিড়ালগুলো দেখতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মারিয়ামদের ঘরে ঢুকলে একদল বিড়াল ছুটে আসে। মিউ মিউ শব্দে যেন বিড়ালগুলো তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল। পরে মারিয়াম সরে যেতে বললে সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালগুলো সরে গেল। এরপর খাট, সোফা, ডাইনিং টেবিল ও চেয়ারে শুয়ে-বসে বিড়ালগুলো নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে মেতে উঠল। সেখানে আলাপকালে মারিয়াম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিড়ালই আমার সব। আমাকে বিয়ে করতে হলে স্বামী নামের মানুষটাকে আমার সঙ্গে বিড়ালগুলোকেও ভালোবাসতে হবে। তা না হলে বিয়ের পিঁড়িতেই বসব না।’

বিড়ালগুলোর সঙ্গে একই শয্যায় ঘুমান মারিয়াম। নিজ হাতে খাবারও খাওয়ান। প্রয়োজনীয় যত্ন নেন। এসব বিড়াল লালন-পালনে প্রতি মাসে খরচ করেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। বিড়ালগুলো নাম এমন—পুতুল, সনু, গুড্ডু, কুবলা খান, মেরি, চেরি, লিলিপুট, লেটকি, পোলকা, ভিক্টোরিয়া, ব্ল্যাকবেরি, চেরি ও মিমি। বাড়ির উঠানে ফুলবাগানের পাশে ২৫টি বিড়ালকে মাটি দেওয়া হয়েছে। ১৪ বছরে নানা কারণে যেসব বিড়াল মারা গেছে, সেসব মৃত বিড়ালের ঠাঁই হয়েছে ফুলবাগানের পাশে। মারিয়ামের পরবর্তী লক্ষ্য, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেওয়ারিশ বিড়ালগুলোর জন্য স্থায়ী নিবাস তৈরি করা। যাতে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এসব বিড়াল যত্নের সঙ্গে বাঁচতে পারে।

মারিয়াম বিনতে জাহাঙ্গীর বলেন, মা মারা যাওয়ার পর ১৪ বছর ধরে বিড়ালগুলোই তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে। বিড়াল পুষতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। বিড়ালের কারণে স্বজনেরা পর্যন্ত বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেন। স্বজনদের নানা কথায় হাল ছেড়ে দেননি। তিনি আরও বলেন, ‘ওই সময়ে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে মারা গেলে আমি মারা যাব। যা হয় হবে, আমি ওদের (বিড়াল) নিয়ে থাকব। মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিড়ালগুলো। বলা যায় আল্লাহ ওদের দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। ওরা না থাকলে হয়তো আমি সারভাইভ করতে পারতাম না।’

বিড়ালের প্রতি মেয়ের এমন ভালোবাসায় দারুণ অনুপ্রাণিত হন বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। মেয়ের পাশাপাশি  তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে বিড়ালের জন্য মাছসহ খাবার কিনে থাকেন। পোষা বিড়ালগুলো কীভাবে সুস্থ-সবল থাকবে, অনলাইন ঘেঁটে বোনকে পরামর্শ দেন ওসামা। রোগবালাই প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্যাকসিন দেওয়াসহ খাবার ও ওষুধপথ্য মারিয়াম নিজেই কিনে আনেন।

নিজের পোষা বিড়ালের সঙ্গে মারিয়াম। মঙ্গলবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা শহরের পুরাতন হাসপাতালপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বিড়ালের প্রতি মারিয়ামের এমন ভালোবাসা বিরল। আমি মেয়ের এই পাগলামিকে দারুণ উপভোগ করি, উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিড়াল পোষা দোষের কিছু না।’

জন্মের পর থেকেই বাড়িতে হাঁস, মুরগি, বিড়াল ও কুকুর পালন করতে দেখেছেন মারিয়াম। ২০০৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকে শখের বশে বাড়িতে সাদা ইঁদুর, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পুষতে থাকেন। নিয়মিত খাবার দেওয়াসহ পরিচর্যা করতেন তিনি। পরিবারের পক্ষ থেকেও তাঁকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হতো। ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার ছয় দিন আগে তাঁর পোষা ৫২টি কবুতর খাটাশে মেরে ফেলে। সে সময় দারুণ ভেঙে পড়েছিলেন।

একসঙ্গে এতগুলো কবুতরের মৃত্যুতে যখন শোকাহত, ঠিক সেই সময়ে সাদা রঙের সবুজ চোখের একটি বিড়ালের দেখা পান। বিড়ালটির প্রতি ভালো লাগা কাজ করে। যখনই বিড়ালটি বাড়িতে আসত, তখন খুব আদর করে কাছে নিয়ে খাওয়াতেন। খাওয়ার পর বিড়ালটি চলে যেত। তাঁর ভালোবাসা পেয়ে বিড়ালটি এক শীতের রাতে তিনটি ছানা নিয়ে হাজির হয়। ঘরের ভেতরে বসবাসের সুযোগ করে দেন তিনি। মা বিড়ালটির নাম দেওয়া হয়েছিল মিয়ামি। তিনটি বাচ্চার নাম দেন ডেভি, ডিউ ও ডারিস। ভাইরাসের কারণে তিনটি বাচ্চা মারা যায়। কয়েক মাস পর বিড়ালটি  চারটি বাচ্চার জন্ম দেয়। নাম দেওয়া হয় বেল্লা, ডোনা, রোজ ও মারিস। চারটার মধ্যে বেঁচে ছিল বেল্লা। বেল্লাকে ভালোবেসে একটি মেয়ে বিড়াল আসে। সেই থেকে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে।