শতবর্ষী টাউন ক্লাবের গল্প

১৯২১ সালে পিরোজপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও ভূস্বামীদের চাঁদায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্লাবটি। ক্লাবের হলঘরটি গোপাল ভৌমিকের নামে করা হয়। টিন ও কাঠের তৈরি দৃষ্টিনন্দন দোতলা একটি ঘর তৈরি করে নাম দেওয়া হয় গোপাল কৃষ্ণ টাউন হল। 

ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত লন টেনিস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, ক্যারমসহ নানা ইনডোর গেমস খেলে থাকেন। ক্লাবের দ্বিতল ভবনে রয়েছে টেবিল টেনিস, ক্যারমসহ ইনডোর খেলাধুলার ব্যবস্থা। এখানে নিয়মিত পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গড়ে উঠতে থাকে পিরোজপুর শহর। আর এই শহরের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিকশিত হতে থাকে গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব ঘিরে। শহরের পেশাজীবীদের দিনের শেষে ক্লান্তি নিবারণ ও আনন্দ বিনোদনের কেন্দ্র ছিল এই ক্লাব। সময়ের পরিবর্তনে কখনো কখনো এর কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। শত বছর ধরে আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনো এটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

১৯২১ সালে পিরোজপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও ভূস্বামীদের চাঁদায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্লাবটি। পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার নকুলেশ্বর ভৌমিক ক্লাবটি প্রতিষ্ঠায় আট হাজার টাকা চাঁদা দেন। ক্লাবের হলঘরটি তাঁর বাবা গোপাল ভৌমিকের নামে করা হয়। টিন ও কাঠের তৈরি দৃষ্টিনন্দন দোতলা একটি ঘর তৈরি করে নাম দেওয়া হয় গোপাল কৃষ্ণ টাউন হল। শুরুতে গোপাল কৃষ্ণ টাউন হলে ছিল স্থায়ী পাকা মঞ্চ, থিয়েটার ও যাত্রা করার অবকাঠামো ও উপকরণ। পদাধিকার বলে ক্লাবের প্রথম সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসক রাজ বিহারী মুখার্জি। ব্রিটিশ আমলে প্রাণচাঞ্চল্য ও বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে চলছে ক্লাবটি। তখন পিরোজপুর শহরে ছিল অভিজাত হিন্দু শ্রেণির বসবাস। দেশভাগের পর অনেক সচ্ছল ও সংস্কৃতিমনা হিন্দু শহর ছেড়ে পশ্চিম বাংলায় চলে যান। এরপর গোপাল কৃষ্ণ টাউন হলে প্রাণচাঞ্চল্যে কিছুটা ভাটা পড়ে।

১৯৪৮ সালের শেষের দিকে গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাবটি আবারও গতি ফিরে পায়। কারণ, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পিরোজপুর শহরে অভিজাত ও সরকারি কর্মকর্তাদের চিত্তবিনোদনের কেন্দ্র ছিল না। পঞ্চাশের দশকে গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাবের মিলনায়তনে শর্ত সাপেক্ষে চালু হয়েছিল ‘চিত্রবাণী’ সিনেমা হল। পরে সিনেমা হলটি ‘ইরা টকিজ’ নামে পরিবর্তিত হয়ে বহুল পরিচিতি লাভ করে। নব্বই দশকের শুরুতে ইরা টকিজ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায়। শর্ত ছিল গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব মিলনায়তন (হলরুম) নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যাবে। ক্লাবের একটি কক্ষকে ঘিরে গড়ে ওঠে ‘পাবলিক লাইব্রেরি’। সরকারি আনুকূল্য পেয়ে এর নাম হয় ‘শেরে বাংলা পাবলিক লাইব্রেরি’। গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাবের উদ্যোগে ও সহায়তায় লাইব্রেরিটি গড়ে ওঠে। 

প্রতিষ্ঠার পর থেকে গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব ঘিরে ছিল শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের মিলনমেলা। সেখানে পত্রপত্রিকা পড়া ও খেলাধুলা হতো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ক্লাবটির বেশ কিছু মূল্যবান উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হন আইনজীবী চণ্ডী চরণ পাল। পদাধিকার বলে সভাপতি পদটিতে সব সময় ছিলেন জেলা প্রশাসক। বর্তমানে ক্লাবটি পরিচালনায় রয়েছে সাত সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আহ্বায়ক ও সরকারি কৌঁসুলি খান মো. আলাউদ্দিন সদস্যসচিব। ২০১০ সালের দিকে গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাবের নতুন দ্বিতল ভবন নির্মাণকাজ শেষ হয়। এরপর দ্বিতল ভবনটি কয়েকবার সংস্কার করে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। ক্লাবের মাঠে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতার মঞ্চ। সেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত লন টেনিস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, ক্যারমসহ নানা ইনডোর গেমস খেলে থাকেন। ক্লাবের দ্বিতল ভবনে রয়েছে টেবিল টেনিস, ক্যারমসহ ইনডোর খেলাধুলার ব্যবস্থা। এখানে নিয়মিত পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ক্লাবের সুদৃশ্য মিলনায়তনে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

২০১৩ সালে গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাবের গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়। বর্তমানে ক্লাবটিতে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। সদস্যসংখ্যা ২৩০ জন। পিরোজপুর জেলার অধিবাসী কমপক্ষে ৩০ বছর বয়সী ব্যক্তিত্বশীল ও সহনশীল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তি ক্লাবের সদস্য হতে পারবেন। ক্লাবের বার্ষিক আয় প্রায় ১২ লাখ টাকা। ক্লাবের পূর্ব ও উত্তর দকে গোপাল কৃষ্ণ টাউন সুপার মার্কেট, মিলনায়তনের ভাড়া ও সদস্যদের মাসিক চাঁদা থেকে মূলত আয় হয়। এ আয় দিয়ে ক্লাবের কর্মচারীদের বেতন ও ভবন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ক্লাবটি খোলা থাকে।

ক্লাবের সদস্য এ বি এম খালিদ আবু বলেন, ‘ক্লাবটিকে ঘিরে এখনো শহরের অভিজাত শ্রেণি ও সরকারি কর্মকর্তাদের আড্ডা বসে। এখানে প্রতিদিন সকালে পত্রিকা পড়া আমাদের রুটিন হয়ে গেছে। বিকেলে ও রাতে ক্লাবের লনে লন টেনিস খেলা হয়। পত্রিকা পড়ার সময়ে রাজনৈতিক আড্ডায় মুখরিত থাকে ক্লাব প্রাঙ্গণ।’