যশোরে পুকুর ভরাট করছেন সরকারি কর্মচারী

কদিন আগে মুক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তুলে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছিল। এখন ট্রলিতে মাটি এনে ভরাট করা হচ্ছে।

সরকারি পুকুরটি মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। গতকাল যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সরকারি এক কর্মচারী তাঁর বাড়ির পাশের সরকারি একটি পুকুর ভরাট করছেন। পুকুরটি ভরাট করতে কদিন আগে মুক্তেশ্বরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছিল। প্রশাসনের নির্দেশনার পর মাঝে কদিন নদী থেকে বালু তোলা ও পুকুর ভরাট—দুই কাজই বন্ধ ছিল। গত সোমবার থেকে আবার পুকুর ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। এবার ট্রলিতে করে মাটি এনে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে।

ঘটনাটি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া এলাকার। পুকুরটি পাঁচবাড়িয়া মৌজায় ২৪ শতাংশ জমির ওপর। অভয়নগর উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর রাহুল দেব সরদার সরকারি পুকুর ভরাট করছেন। তিনি নিজে পুকুর ভরাটের কথা স্বীকার করেছেন।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে পুকুরটির ১০-১৫ শতাংশ ভরাট হতে দেখা যায়। এ সময় ছবি তুলতে গেলে মাটি ফেলার কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা কয়েকজন এই প্রতিবেদককে তাড়া করেন।

‘মুক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তোলার জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিষয়টি তদন্তের জন্য লোক পাঠানো হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জাকির হোসেন, মনিরামপুরের ইউএনও

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬-এর ঙ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।’

বালুমহাল আইন লঙ্ঘন করে ১৩ মে পাঁচবাড়িয়া মৌজায় মুক্তেশ্বরী নদী থেকে অবৈধভাবে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করেন রাহুল দেব। নদী থেকে পাইপের সাহায্যে ২০০ মিটার দূরে বালু ফেলা হচ্ছিল তাঁর বাড়ির পাশের সরকারি পুকুরে।

এ পরিস্থিতিতে ১৪ মে এলাকাবাসী মুক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তোলা বন্ধ করতে মনিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করেন। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও পুকুর ভরাটের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে ১৭ মে থেকে কয়েক দিন কাজ বন্ধ থাকে। কিন্তু গত সোমবার থেকে ট্রলিতে করে মাটি এনে পুকুর ভরাট করতে দেখা যায়।

অবৈধভাবে বালু তুলে সরকারি পুকুর ভরাটের বিষয়ে রাহুল দেব সরদার বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তার পাশে পুকুর। পুকুরের এক পাড়ে আমার দোতলা বাড়ি। পাশের রাস্তা ভেঙে পুকুরের মধ্যে পড়ছে। ওই পুকুর ৪৫ বছর ধরে অন্য লোকের নামে ইজারা ছিল।

ক্লাব এবং আমার স্ত্রীর নামে বরাদ্দ নিয়ে আড়াই লাখ টাকা চুক্তিতে নদীর বালু নিয়ে জনস্বার্থে ওই পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। বেশির ভাগ টাকা আমি দিয়েছি। ক্লাবের সদস্যরাও কিছু টাকা দিয়েছেন। ভরাটের পর ওই জমিতে খেলার মাঠ করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নদী থেকে বালু তোলার অনুমতির জন্য ইউএনও ও এসি ল্যান্ড স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। “ভালো কাজ” করছি শুনে তাঁরা খুব খুশি হয়েছেন। বালু তোলার জন্য তাঁরা মৌখিক অনুমতি দিয়েছেন।’

তবে এ বিষয়ে মনিরামপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলী হাসান বলেন, ‘নদী থেকে বালু তোলা যাবে না। আমি কাউকে মুক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তোলার অনুমতি দিতে পারি না। কাউকে অনুমতি দেওয়াও হয়নি। মু্ক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তোলার খবর পেয়ে লোক পাঠিয়ে তা বন্ধ করেছি।’

১৭ মে নদী থেকে বালু উত্তোলন এবং একই সঙ্গে পুকুর ভরাটের কাজ বন্ধ থাকতে দেখা যায়। কিন্তু গত সোমবার বিকেল থেকে ট্রলিতে মাটি এনে আবার পুকুর ভরাটের কাজ শুরু হয়। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পুকুর ভরাটের কাজ চলছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচবাড়িয়া মৌজার ২১৯৭ নম্বর দাগের ২৪ শতাংশ জমিতে একটি সরকারি পুকুর রয়েছে। পাঁচবাড়িয়া গ্রামের নিতাই চন্দ্র মল্লিক প্রায় ৪৫ বছর ওই জমি একসনা (বাংলা সন) ভিত্তিতে ইজারা নিয়ে মাছের চাষ করে আসছিলেন। উপজেলা ভূমি কার্যালয় থেকে দুই বছর ওই জমি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি।

চলতি বছর ওই জমি থেকে ২০ শতাংশ ইজারা দেওয়া হয়েছে পাঁচবাড়িয়া গ্রামের নবজাগরণ সমাজকল্যাণ সংঘ নামের একটি ক্লাবকে। বাকি ৪ শতাংশ জমি ইজারা নিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন অভয়নগর উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর রাহুল দেব সরদারের স্ত্রী এবং মনিরামপুর উপজেলার মশিয়াহাটী ডিগ্রি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক লাভলী মল্লিক। রাহুল দেব সরদার নবজাগরণ সমাজকল্যাণ সংঘের সভাপতি।

নদী থেকে বালু তোলার নিয়ম নেই উল্লেখ করে মনিরামপুরের ইউএনও জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তোলার জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিষয়টি তদন্তের জন্য লোক পাঠানো হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’