বিএনপি নির্বাচনে গেলে বরিশালে মেয়র প্রার্থী কে হবেন

বরিশাল সিটি করপোরেশন

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে, তার একটি বরিশাল সিটি। মে থেকে জুনের মধ্যে এ নির্বাচন হবে। এ নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। তবে বিএনপির মতো বড় দল এ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা নিয়ে কৌতূহল আছে। দলটি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশে নেয়ই, তাহলে মেয়র প্রার্থী কে হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা আছে রাজনৈতিক মহলে।

বিগত দিনে বরিশাল সিটি করপোরেশন ও বরিশাল সদর আসনে নির্বাচন এলে বিএনপির প্রার্থী কে হবেন, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনার সুযোগ ছিল না। কারণ, এ দুটি পর্যায়েই প্রার্থী ছিল নির্ধারিত। সিটিতে হয় মজিবর রহমান সরোয়ার, না হয় আহসান হাবিব কামাল। আবার সদর আসনে সংসদ নির্বাচনে মজিবর রহমান সরোয়ারই ছিলেন একক প্রার্থী। কিন্তু গেল পাঁচ বছরে কীর্তনখোলা নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে, তেমনি এই নদীতীরের শহর বরিশালে বিএনপির রাজনীতিতেও নেতৃত্বের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে এসেছে পরিবর্তন। সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল গত বছর মারা গেছেন। আর বরিশালে বিএনপির রাজনীতির একচ্ছত্র আধিপত্য হারিয়েছেন মজিবর রহমান সরোয়ার। ফলে সাধারণ ভোটারদের কৌতূহল যতটা না ভোট নিয়ে, তার চেয়ে বেশি নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপির হাল ধরার মানুষটি কে হবেন, তা নিয়ে।

বুধবার রাতে শহরের পুলিশ লাইনস সড়কের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছিলেন সাত বন্ধু। তাঁরা সবাই চল্লিশোর্ধ্ব। এর মধ্যে চারজন পেশায় ব্যবসায়ী, দুজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী, একজন আইনজীবী। তাঁরা কেউই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। তাঁরা নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটার। খাবার পরিবেশন করতে দেরি হওয়ায় আলোচনায় মজেন তাঁরা। আলোচনার বিষয় সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন। তাঁদের একজন বলছিলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে না এলে সেই নির্বাচন করে লাভ কী?’ এমন প্রশ্ন শুনে আরেকজন বললেন, ‘বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে বরিশালে এবার দলের মেয়র প্রার্থী হবেন কে?’ তখন মৃদু হেসে একজন বলেন, ‘এইটা একটা ভাইটাল কোশ্চেন, আসলেই কে?’ আরেকজন বলেন, ‘যে যা–ই বলুক না কেন, এখানে এখনো সরোয়ারের বিকল্প নেই’। কিন্তু দুজন এতে একমত না হয়ে বলেন, ‘এখন নতুনদের সামনে আনা  উচিত’। এ মন্তব্যের পর আরেকজন উঠে বলেন, ‘সেই নতুনটা কে, কাকে আনতে বলো তুমি?’ এভাবে আলোচনা এগোচ্ছিল।

বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। দলটি আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। এরপরও সামনের সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বরিশালের ভোটারদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না, এ প্রশ্ন। এলে দলটির মেয়র প্রার্থী কে হবেন?

মজিবর রহমান সরোয়ার বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র ছিলেন। ওই সময় তিনি সদর আসনের সংসদ সদস্যও ছিলেন। ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ। বরিশাল সদর আসন থেকে তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। একসময় দলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল। তিনি গত বছরের ৩০ জুলাই মারা যান। ফলে কামালশূন্য বিএনপিতে সরোয়ারের সামনে আর কোনো নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী থাকার কথা নয়। কিন্তু ২০২১ সালের নভেম্বরে মজিবর রহমান সরোয়ার বরিশাল নগর বিএনপির সভাপতির পদ হারান। তাঁর বিরোধী হিসেবে পরিচিত একটি পক্ষ নগর বিএনপির নেতৃত্ব পাওয়ায় তিনি অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তবে দলের তৃণমূল পর্যায়ে তাঁর এখনো জনপ্রিয়তা আছে। দলে তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা কোণঠাসা হওয়ায় সরোয়ারের নির্বাচনী রাজনীতিও এখন হুমকিতে। ফলে বিএনপি যদি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়ই, তাহলে এবার মেয়র পদে দলে কে মনোনয়ন পাবেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, নগর বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির কয়েকজন নেতা ভেতরে-ভেতরে মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী। একইভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সদর আসনে সংসদ সদস্যপদে মনোনয়নপ্রত্যাশী সরোয়ারবিরোধীরা। মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান, সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির। এ ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহানের নামও আসছে ঘুরেফিরে।

মহানগর বিএনপির কয়েকজন সাবেক নেতা দাবি করেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের ভোটের রাজনীতিতে সরোয়ার-কামালের বিকল্প নেতা এখনো তৈরি হয়নি। সে ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে বিকল্প কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার কাজটা অনেকটাই কঠিন কাজ হবে দলের জন্য।

তবে নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ওই নেতাদের এমন দাবির সঙ্গে একমত নন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বরিশাল বিএনপির ঘাঁটি। এখানে আওয়ামী লীগের তৎকালীন অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় মেয়র শওকত হোসেন হিরনের বিরুদ্ধে অসুস্থ আহসান হাবিব কামালকে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছিল। শওকত হোসেন তাঁর কাছে ২০ হাজার ভোটে হেরেছিলেন। তাই এখানে বিএনপির প্রার্থীর অভাব নেই।  

এ নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছেন সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে, এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। আর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থিতার ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহই নেই। গতবারও ছিল না। দলীয় মহাসচিব আমার পক্ষে মনোনয়ন ফরম কিনে জমা দিয়েছিলেন বলে ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। সেবার কোনো ভোটই হয়নি, দুপুরের অনেক আগেই সব কেন্দ্রের ব্যালট শেষ হয়ে গিয়েছিল। নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে আমাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার–নির্যাতন করা হয়েছিল।’

এরপরও বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে সিদ্ধান্ত কী হবে জানতে চাইলে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘সেটা দলের হাইকমান্ড বিবেচনা করবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী দলই ঠিক করবে কাকে দিলে ভালো হবে। তবে ভবিষ্যতে বিএনপি নির্বাচনে গেলে আমি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাই, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে কোনো আগ্রহ নেই।’