দুই বছরেও শেষ হয়নি ৫৫ মামলার তদন্ত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার গোলচত্বর এলাকায় জড়ো হয়ে রাস্তা অবরোধ করে হেফাজতে ইসলামের নেতা–কর্মীরা। ২০২১ সালের ২৮ মার্চ সকালে
প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের ভয়াবহ সহিংসতার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা ২৬ থেকে ২৮ মার্চ টানা তিন দিন জেলার ৫৮টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালান। সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত হন। নাশকতার ঘটনায় করা ৫৭টির মধ্যে মাত্র ২টি মামলায় ২৯১ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। বাকি ৫৫টি মামলার তদন্ত দুই বছরেও শেষ হয়নি।

সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার ১ হাজার ৫০ জনের মধ্যে ৯৮৫ জন জামিন পেয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বাড়িতে এখনো চলছে আহাজারি। স্বজনেরা বিচার নিয়েও শঙ্কিত।

থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সহিংসতার শুরু ২৬ মার্চ বিকেলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় ও চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসায় সংঘর্ষের জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। ট্রেনের কন্ট্রোল প্যানেল, সাত-আটটি টিকিটভর্তি আলমারিসহ সব কক্ষ আগুন দেওয়া হয়।

২৭ মার্চ সরাইল উপজেলার অরুয়াইল পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। বেলা সাড়ে তিনটা থেকে পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত সদর উপজেলার নন্দনপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। পাঁচটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদিরের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করা হয়। শহরের টি এ এলাকা অতিক্রম করার সময় মিছিলকারীদের সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্রদের সংঘর্ষ বেধে যায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষাচত্বরে আয়োজিত জেলা প্রশাসনের উন্নয়ন মেলার ৪৩টি স্টল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে
প্রথম আলো

২৮ মার্চ হেফাজতের হরতালের দিন সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়, পৌরসভাসহ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ২৬ থেকে ২৮ মার্চ তিন দিন জেলার অন্তত ৫৮টি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় হামলা হয়।

সুহিলপুর ইউনিয়নের হারিয়া গ্রামের বাসিন্দা জুরু আলম ২৭ মার্চ বিকেলে নন্দনপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ-বিজিবি ও হেফাজতে ইসলামের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাঁর স্ত্রী রোজিনা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী কোনো রাজনীতি করতেন না। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। তাঁরা গরিব। গরিবদের বিচার পাওয়ার আশা করা উচিত না। সেখানে স্বামীর মৃত্যুর বিচার পাবেন, আশা করবেন কীভাবে।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত টানা তিন দিন হেফাজতের সহিংসতার ঘটনায় ৫৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে সদর থানায় ৪৯টি, সরাইল থানায় ২টি, আশুগঞ্জ থানায় ৪টি ও আখাউড়া রেলওয়ে থানায় ২টি মামলা হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সদর থানা-পুলিশ একটি ও ডিবি পুলিশ একটি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে।

৫৭টি মামলায় এজাহারভুক্ত ৪৬ জন ও সন্দেহভাজন ১ হাজার ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৪ জন বিএনপির নেতা-কর্মী, ৩ জন জামায়াত-শিবির ও অন্যরা হেফাজতের ইসলামের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। এখন পর্যন্ত ৯৮৫ জন জামিন পেয়েছেন। আর কারাগারে রয়েছেন ৬৫ জন। জেলা পুলিশের কাছে তদন্তাধীন ৩৬ মামলায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পরিদর্শক কাজী দিদারুল আলম বলেন, হেফাজতের সহিংসতার মামলাগুলোর মধ্যে দুটিতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। তবে আদালত এখনো সেগুলো দেখেননি। এর মধ্যে একটি মামলায় আগামী ২০ এপ্রিল এবং আরেকটি মামলায় ২৫ মে পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোল প্লাজায় ভাঙচুর চালানো হয়। ২০২১ সালের ২৮ মার্চ সকালে
প্রথম আলো

সহিংসতার ঘটনার সময় জেলা হেফাজতে ইসলামের সভাপতি ছিলেন সাজিদুর রহমান। বর্তমানে তিনি হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব। তিনি বলেন, তাঁদের একজন আলেমসহ অনেক সাধারণ মানুষ এখনো কারাগারে রয়েছেন। তাঁদের জামিনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। আর হেফাজতের সহিংসতার ঘটনায় হওয়া মামলাগুলো নিষ্পত্তি, প্রত্যাহার বা মামলাগুলোয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কারণ, সহিংসতার সঙ্গে হেফাজতের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা জড়িত না।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) সোহরাব আল হোসাইন বলেন, সদর থানা ২৭টি মামলার তদন্ত করছে। এর মধ্যে একটি মামলায় সদর থানা ও আরেকটি মামলায় ডিবির পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অন্যগুলোর তদন্ত চলছে।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, সহিংসতার মামলাগুলোয় অনেক আসামি রয়েছে। অনেকেই পলাতক। তাঁদের নাম, ঠিকানা ও সংশ্লিষ্টতা যাচাইসহ তথ্য সংগ্রহে সময় লাগছে। পুলিশ বসে নেই, মামলাগুলোর তদন্ত করছে।