তানোরে বিলুপ্তপ্রায় ধানের বীজ বিনিময় ও নবান্ন উৎসব, তিন কৃষককে সম্মাননা

বিলুপ্তপ্রায় ধানের বীজ বিনিময় করেছেন এক নারী কৃষক। আজ দুপুরে তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর তানোরের দুবইল গ্রামে অষ্টমবারের মতো বিলুপ্তপ্রায় ধানের বীজ বিনিময় ও নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎসবে ১৫ জন কৃষক নিজেদের মধ্যে ধানের বীজ বিনিময় করেন। এদিকে চাষের মাধ্যমে দেশি বীজ সংরক্ষণে অবদান রাখার জন্য একই অনুষ্ঠানে তিনজন কৃষককে সম্মাননা দেওয়া হয়।

লুপ্ত ধানের সংগ্রাহক ইউসুফ মোল্লার প্রতিষ্ঠিত ‘বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংকের’ অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে সহযোগিতা করছে বারসিক নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। নিয়ম অনুযায়ী, এক কেজি বীজ নিয়ে চাষ করলে মৌসুম শেষে দুই কেজি বীজ ব্যাংকে ফেরত দিতে হয়। এতে বীজ ব্যাংক বীজে সমৃদ্ধ হয়। কৃষকেরা চাহিদা অনুসারে বীজ নিতে পারেন।

এ বছর সম্মাননা পাওয়া তিন কৃষক হলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার বিলকিস বেগম, তানোর উপজেলার মুণ্ডমালা পৌর এলাকার তোজিদ আলী ও দুবইল গ্রামের আবদুল আল খালিদ। এবারের উৎসবে রাজশাহীর তানোর, পবা, গোদাগাড়ী, নাচোল ও নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ১৮ গ্রামের ২৫০ জন কৃষক ও কিষানি অংশ নেন। উৎসবের আগের দিনরাত থেকে চলতে থাকে বৈচিত্র্যময় পিঠাপুলি বানানোর কাজ। এ কাজে সহযোগিতা করেন গ্রামের নারীরা।

স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পংকজ চন্দ্র দেবনাথ। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মদ এবং নদী ও পরিবেশ গবেষক মো. মাহাবুব সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন ইউসুফ মোল্লার ছোট ভাই মো. জাইদুর রহমান।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক স্থানীয় জাতের ধান সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। যদিও এ কাজ অনেক কঠিন এবং ব্যয়বহুল। তবে বীজগুলো আমাদের দেশের সম্পদ। আমরা এ কাজে সব সময় সহযোগিতা করব। কারণ, বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য উপযোগী অনেক ধানের জাত এ ব্যাংকে সংরক্ষিত আছে।’

উৎসবের আগের দিন থেকে চলতে থাকে বৈচিত্র্যময় পিঠাপুলি বানানোর কাজ
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক চমৎকার কাজ করছে। বিশেষ করে কৃষকেরা এখান থেকে বীজ নিয়ে চাষ করে আবার বীজ ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন—এটা অনেক ভালো একটা দিক। এতে দেশি ধানের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ইউসুফ মোল্লা দেশি বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর এ সংগ্রহশালা যদি সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তাহলে এ বীজ ব্যাংক অনেক সমৃদ্ধ হবে এবং কৃষকেরা উপকৃত হতে থাকবেন।

প্রথমের মতো এ উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন তানোর উপজেলার বিল্লি গ্রামের শাহানাজ বেগম (৪১)। তিনি লোকমুখে শুনেছিলেন দুবইল গ্রামের নবান্ন উৎসবের কথা। এবার আগে থেকে খোঁজখবর নিয়ে উৎসবে এসেছেন। তিনি বলেন, বীজ ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা রাঁধানীপাগল ও কালিজিরা ধানের বীজ নিয়ে তিনি জমিতে চাষ করবেন।

নাচোল উপজেলার ঝিলিমপুর গ্রাম থেকে এসেছিলেন মো. মাহাবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার অনেক জমি পানির অভাবে পড়ে থাকে। তাই আমি এসেছি বীজ ব্যাংক থেকে খরাসহনশীল ধানের জাত নিতে। এখানে এসে অনেক কৃষকের সঙ্গে পরিচিত হলাম, তাঁদের কাজ সম্পর্কে জানতে পারলাম।’

অনুষ্ঠান শেষে কৃষেকরা নিজেদের মধ্য বীজ বিনিময় করেন। পরে অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা ও ঝিঙ্গাশাইল ধানের ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

ইউসুফ মোল্লা তাঁর কাজের জন্য জাতীয় পরিবেশ পদক-২০১৩ পেয়েছিলেন। তিনি দেশি জাতের ধানবীজসহ বিভিন্ন সবজি বীজ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর ব্যাংকের সংগ্রহে আছে ৩০০টি জাতের ধানবীজ, ২৫ জাতের বিভিন্ন দেশীয় সবজিবীজ ও ১৫ জাতের রবিশস্যের বীজ। গত ১৪ জানুয়ারি ইউসুফ মোল্লা মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই জাইদুর রহমান এই ব্যাংকের হাল ধরেছেন।