‘জিব্বাডা পর্যন্ত পুইড়া গেছে, পোলাডায় রাইতে কথা কইতে পারে নাই’

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটফাইল ছবি

‘হাত, পা, শরীর, চোখ, মাথা—সব জাগায় আগুন লাগছে। আগুনে পাও থেইকা মাথা পর্যন্ত সব পুড়ছে। মুখের ভিতরে জিব্বাডা পর্যন্ত পুইড়া গেছে। পোলাডায় রাইতে কথা কইতে পারে নাই। সকাল থেইকা কোনো হুঁশ নাই।’

অগ্নিদগ্ধ ছেলের অবস্থা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সবুরণ বেগম। তাঁর ছেলে ইকবাল হোসেনসহ (৩৫) চারজন গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মুন্সিগঞ্জের একটি প্লাস্টিক গলানোর কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডে আহত অন্যরা হলেন ইকবালের খালাতো বোনের স্বামী রিয়াজুল ইসলাম (৩৮), ইকবালের চাচাতো ভাই রাকিব হোসেন (২৬) ও মতিউর রহমান (৩৩) নামের এক ব্যক্তি। মতিউর কুড়িগ্রামের তাঁতীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। ইকবাল, রিয়াজুল, রাকিব ফরিদপুরের সালথা উপজেলার কাঠাবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা। তাঁরা সবাই মুন্সিগঞ্জ সদর ও নারায়ণগঞ্জের সীমান্তবর্তী মুক্তাপুর জেকে প্লাস্টিক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁদের মধ্যে রাকিবের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও অন্য তিনজনের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানান স্বজনেরা।

ছেলে ও স্বজনদের হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে সেখানেই আছেন সবুরণ বেগম। আজ শুক্রবার তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি ছেলে ও স্বজনদের শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জানান, রাকিবের অবস্থা একটু ভালো। তিনি খেতে পারেন, হাঁটতে ও কথা বলতে পারেন। তবে ইকবাল ও রিয়াজুলের অবস্থা খুব খারাপ। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। দুজনকে আইসিইউতে রেখেছেন। তাঁরা অচেতন অবস্থায় আছেন। মুঠোফোনে কান্না করতে করতে সবুরণ বলেন, ‘ডাক্তার গো ছেলের কথা জিগাইছিলাম। তারা কয়, ‘‘আল্লাহরে ডাকেন’’।’

হাসপাতালে মতিউর রহমানের সঙ্গে আছেন চাচা জাহাঙ্গীর আলম। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে মতিউরের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। শরীরের তিন ভাগের দুই ভাগের বেশি পুড়ে গেছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন ছয় ব্যাগ রক্ত লাগবে। রক্ত দেওয়ার পরও মতিউর সুস্থ হবে কি না, কিছুই বলছেন না।’

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল রাতে ওই কারখানায় প্লাস্টিক গলিয়ে চাপটি তৈরির কাজ করছিলেন চার শ্রমিক। রাত পৌনে ৯টার দিকে প্রথমে ধোঁয়া, তার কিছুক্ষণ পর কারখানার টিনের চালার ওপর দিয়ে আগুন দেখেন তাঁরা। এরপর আশপাশে লোকজন সেখানে ছুটে যান। সে সময় স্থানীয়ভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করার পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকে খবর দেওয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে চারজনকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। রিয়াজুলকে সরাসরি ঢাকায় এবং মতিউর, ইকবাল ও রাকিবকে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।

মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রুহুল আমিন বলেন, রাত সোয়া ৯টার দিকে তিনজনকে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজনের শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঝলসে ছিল। তাঁদের তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

ঘটনার পর আহত শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, কারখানায় সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। হঠাৎ সেখানে বিস্ফোরণের শব্দ হয়। মুহূর্তের মধ্যেই কারখানায় আগুন ধরে যায়। তাঁরা কারখানা থেকে বের হতে হতেই পুড়ে যান। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করেন।

কারখানার ভেতরের বৈদ্যুতিক মিটারের গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে জানান মুন্সিগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. আবু ইউসুফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাত পৌনে ৯টার দিকে আগুন লাগার বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষণিক তাঁরা ঘটনাস্থলে যান। মুন্সিগঞ্জের দুটি, নারায়ণগঞ্জ থেকে আরও দুটিসহ মোট চারটি ইউনিট ৩০ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রাত ১০টার মধ্যে সম্পূর্ণ আগুন নেভাতে সক্ষম হন তাঁরা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, মুন্সিগঞ্জ সদরে কম করে হলেও ৫০টির বেশি এমন প্লাস্টিক গলানোর কারখানা আছে। এসব কারখানার কাজ বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে। সব সময় কারখানা উত্তপ্ত থাকে। কারখানা ঠান্ডা রাখা এবং অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে সামান্য বিস্ফোরণে মুহূর্তের মধ্যে কারখানায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনার পর ওই এলাকায় মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) থান্দার খায়রুল হাসানের নেতৃত্ব পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে তারা। খায়রুল হাসান বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি, আহত তিনজনের মধ্যে ইকবাল ও মতিউর রহমানের শরীরের ৬০ ভাগ পুড়ে গেছে।’