সবজির দাম পাচ্ছেন না কৃষকেরা, করলার মণ নেমেছে ৬০০ টাকায়

খেত থেকে করলা তুলে সড়কের পাশে পাইকারের অপেক্ষায় বসে আছেন কৃষক। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খড়িবাড়ি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

চারদিকে সবুজের মাঝে এঁকেবেঁকে গেছে গ্রামীণ পথ। ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, ঝোপঝাড়। হঠাৎ পথের ধারে আটকে যায় দৃষ্টি। করলার স্তূপের পাশে বসে মুঠোফোনের বোতাম চেপে যাচ্ছেন এক কৃষক। চোখে-মুখে তাঁর বিরক্তির ছাপ। কারণ জানালেন, খেতে পাইকার আসার কথা ছিল। কিন্তু আসছেন না। খেত থেকে করলা তুলেই বিপদে পড়েছেন।

এই কৃষকের নাম জহিরুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার খড়িবাড়ি গ্রামে। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের আগে প্রতি মণ করলার বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকায়। সেই করলা আজ সোমবার ৬০০ টাকায়ও কেউ কিনছেন না। বাইরের পাইকাররা আসতে না পারায় সবজির দাম পড়ে গেছে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খড়িবাড়ি, আকচা, ঢোলারহাট, রাজাগাঁও, নারগুন, গড়েয়াসহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপক সবজি আবাদ হয়। পাইকারেরা এসব এলাকার খেত থেকে সবজি সংগ্রহ করে দেশের বড় বড় জেলায় সরবরাহ করেন। কৃষকেরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতে ভালো দাম পেলেও টানা হরতাল-অবরোধের কারণে সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল কমছে। এতে পাইকারেরা দেশের বড় বড় শহরে সবজি পাঠাতে সাহস করছে না। এর প্রভাব পড়েছে সবজির বাজারে। আবার ট্রাকের ভাড়াও বেড়েছে। এতে সবজির দামে ধস নেমেছে।

অবরোধের আগে কুমিল্লায় সবজি পরিবহনে ভাড়া ছিল ৩৫ হাজার টাকা আর আজ দিতে হচ্ছে ৫৩ হাজার টাকা। এতে অনেকেই সবজি কিনছেন না।
হাবিবুর রহমান, সবজি ব্যবসায়ী, ঠাকুরগাঁও

আজ কয়েকটি এলাকার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মণ চিচিঙ্গা ৪৮০ থেকে ৫৬০, ফুলকপি ১ হাজার, লম্বা বেগুন ৫৬০, গোল বেগুন ১ হাজার ২০০; বাঁধাকপি প্রতিটি ২০ থেকে ২২ ও ছাচি লাউ প্রতিটি ১৪ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছে।

অবরোধের আগে গত ২৮ অক্টোবর প্রতি মণ চিচিঙ্গা ৬৪০ থেকে ৭২০, ফুলকপি ১ হাজার ৬০০, লম্বা বেগুন ৮০০, গোল বেগুন ১ হাজার ৬০০; বাঁধাকপি প্রতিটি ৩২ থেকে ৩৪ ও ছাচি লাউ প্রতিটি ২৭ থেকে ২৮ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছিল। তবে সবচেয়ে কমেছে করলার দাম। হরতাল-অবরোধের আগে প্রতি মণ করলা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। আজ বিক্রি হয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। এ ছাড়া বরবটি, পেঁপে, শসা, শিমসহ সব ধরনের সবজির দাম কমেছে।

সদর উপজেলার ফাঁড়াবাড়ি থেকে পাটিয়াডাঙ্গী সড়কের পাশের করলাখেত পরিচর্যা করছিলেন খড়িবাড়ি গ্রামের কৃষক আতাউর রহমান। তিনি বলেন, দেড় বিঘা জমিতে করলা আবাদ করেছিলেন। মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ করলা সর্বোচ্চ ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে একবারেই দাম কমে গেছে। আজ প্রতি মণ করলা ৬০০ টাকায় বিক্রি করলেন।

কিছু দূর এগিয়ে দেখা যায়, খেত থেকে করলা তুলে আনতে ব্যস্ত সুধীর রায়। এর মধ্যেই এক ব্যক্তি এসে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন। সুধীর হাত নেড়ে তাঁকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। পরে তিনি বললেন, ‘ওই লোকখান একজন পাইকার। খেত থাকিয়া সবজি কিনে বাহিরত পাঠায়। আইজ করলার দাম ৫৫০ টাকা কহছে। মুই ৭০০ টাকা কহিছু। ও দিবা চাহেছেনি।’ অবরোধের কারণে পাইকারেরা তাঁদের কাছ থেকে সস্তায় সবজি কিনছেন বলে জানান তিনি।

সদরের দক্ষিণ বঠিনা গ্রামের হরিপ্রসাদ রায় ১২ শতক জমিতে লাউ চাষ করেছেন। তিনি বললেন, এবার লাউয়ের দাম ভালোই ছিল। হরতাল-অবরোধ শুরু হয়ে দাম কমে গেল। আগে যে লাউ ২৭ থেকে ২৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন সেই লাউ ১৪ থেকে ১৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মাল বাহিরত যাচে না, এইতানে পাইকারও নাই। যা–ও আছে, তারা লাউলার দাম কম কহছে।’

খেত থেকে করলা তুলে স্তুপ করে রাখছেন কৃষক। আজ সোমবার সকালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খড়িবাড়ি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

দক্ষিণ বঠিনার পাশের গ্রাম বরদ্বেশ্বরী। সেখানের কৃষক রহমত আলী বলেন, খেত থেকে সময়মতো সবজি না তুললে নষ্ট হয়ে যায়। সে কারণে কম দামেই সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি জানান, গত বুধবারে এক মণ করলা বিক্রি করে ৯৮০ টাকা পেয়েছিলেন। আর আজ পেলেন ৬০০ টাকা। প্রতিদিনই দাম কমছে।

ওই এলাকার কৃষক রাজেশ বর্মণ, আনোয়ার হোসেন, শহিদুল হকসহ কয়েকজন বলেন, এলাকার অনেকেই খেতের করলা, লাউ, ফুলকপি, বেগুন তুলে রেখেছিলেন। সকালে পাইকার ট্রাক নিয়ে আসার কথা। কিন্তু তাঁরা আসেননি। সেসব সবজি স্থানীয় বাজারে তাঁদের কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে।

বছর পাঁচেক ধরে ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকের কাছ থেকে সবজি কিনে কুমিল্লায় সরবরাহ করেন হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, অবরোধের কারণে ঝুঁকি নিয়ে সবজি কিনলেও মোকামে পাঠানো নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ছেন। যানবাহন পাওয়া যাচ্ছে না। আর পাওয়া গেলেও ভাড়া অনেক বেশি চাইছে। অবরোধের আগে কুমিল্লায় সবজি পরিবহনে ভাড়া ছিল ৩৫ হাজার টাকা আর আজ দিতে হচ্ছে ৫৩ হাজার টাকা। এতে অনেকেই সবজি কিনছেন না।

‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ পাওয়া চামেশ্বরী গ্রামের মেহেদী আহসানউল্লাহ চৌধুরী বলেন, আগে ঢোলারহাট, রাজাগাঁও থেকে প্রতিদিন সবজি নিয়ে ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাক অন্য জেলার যেত। আর এখন দুই থেকে তিনটি ট্রাক যায়। এ কারণে কৃষকেরা সবজির দাম পাচ্ছেন না।

অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ঠাকুরগাঁওয়ে সবজির ফলন ভালো হয়ে থাকে উল্লেখ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ জেলায় উৎপাদিত সবজি স্থানীয় প্রয়োজন মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। এতে কৃষকেরা বেশ লাভবান হন। তবে রাজনৈতিক এ পরিস্থিতিতে পাইকারেরা বাইরে সবজি পাঠাতে পারছেন না। ফলে জেলায় সবজির দাম পড়ে গেছে।