শাল-গজারি বনজুড়ে বসন্ত উৎসব, অজস্র ফুলের সমারোহে অপার মুগ্ধতা

বসন্তের শেষে শাল-গজারি বন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল যেন ফুলের বিছানা পাতা। সম্প্রতি কাপাসিয়ার ভাওয়াল বনেছবি: প্রথম আলো

প্রকৃতিতে যাই যাই করছে বসন্ত। এমন সময় বাহারি ফুলের রং আর গন্ধের জাদুকরি মোহনীয়তা ছড়িয়ে পড়েছে গাজীপুরের শাল-গজারি বনজুড়ে। গাছে গাছে কচি পাতার সঙ্গে অজস্র ফুলের সমারোহ ছড়াচ্ছে অপার মুগ্ধতা।

প্রকৃতির নিয়মে প্রতিবছর মার্চের শুরুতে শাল-গজারি বনে হলুদ রঙের ফুল ফুটতে শুরু করে। এপ্রিলের শুরুর দিকে ফুলগুলো রং পাল্টে হয়ে ওঠে বাদামি। মূলত রঙের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ফুলে বীজের সূত্রপাত হয়। ফুলগুলো বীজে পরিণত হওয়ার পর গন্ধ না থাকলেও ভিন্ন এক সৌন্দর্যে ছেয়ে যায় পুরো বন। বীজগুলো একসময় মাটিতে ঝরে পড়ে। কাঁচা অবস্থায় ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় মৌমাছির দল। এ সময় সুগন্ধে মোহিত থাকে চারপাশ।

গাছ থেকে বীজের এই ঝরে পড়ার এক বিচিত্র পদ্ধতি আছে। বীজের সঙ্গে যুক্ত থাকে শুকনা পাপড়ি। বীজের এক প্রান্তে পাপড়িগুলো সাজানো থাকে। এটি গাছ থেকে ঝরে পড়ার সময় শুকনা পাপড়িগুলো ঘুরতে ঘুরতে বীজকে বেশ দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। বনজুড়ে গাছ থেকে বীজের এ ছন্দময় পতন এক অন্য রকম সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। এ সময় বনভূমিতে শুকনা পাতার মতো ছড়িয়ে থাকে শাল-গজারির ঝরে পড়া ফুল। বনের ভেতর পায়ে হাঁটা ছোট পথগুলোতে ঝরে পড়া ফুল যেন মাদুর বিছিয়ে দেয়।

মার্চ-এপ্রিলজুড়ে গাজীপুরের শাল–গজারি বনে যেন বসন্তের উৎসব চলে
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের শালবন মূলত সদর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া—এই তিন উপজেলায় বিস্তৃত। শিল্পসমৃদ্ধ শ্রীপুর উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে এখনো টিকে আছে কিছু সবুজ অঞ্চল। এসব বনে শুধু শাল ফুলই ফোটে না। কনকচাঁপা, জারুল, শিমুল, শেফালি, শিরীষ, মান্দার, কামিনী, অতসী, দাঁতরাঙা, কাঞ্চন, বেলী, কদম, রঙ্গন ফুলও আছে বাসন্তী সমারোহে।

গত মঙ্গলবার যাওয়া হয় ভাওয়াল বনাঞ্চলের শ্রীপুর ও কাপাসিয়া অংশের সিমলা পাড়া, শিরীষগুঁড়ি, সাতখামাইর, গোসিংগা, দরদরিয়া এলাকায়। বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে শোনা যায় নানা প্রজাতির দেশি পাখির কলকাকলি। পথে বেশ কয়েকজন ভ্রমণপিপাসুর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা কেউ ফুলের ছবি তুলছিলেন, কেউ স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ভিডিও করছিলেন বনের সৌন্দর্য।

শিরীষগুঁড়ি গ্রামের পথে প্রান্তরে অসংখ্য শাল-গজারির ফুল ছড়িয়ে আছে। ওই গ্রামের মো. আতিকুল ইসলাম জানান, ফুলগুলো শুধু সৌন্দর্যই বিলায় না, এগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শেষ পর্যন্ত রান্নার জ্বালানির উৎসে পরিণত হয়।

গাছে গাছে কচি পাতার সঙ্গে অজস্র ফুলের সমারোহ ছড়াচ্ছে অপার মুগ্ধতা
ছবি: প্রথম আলো

কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে বানার নদের পার ঘেঁষে বিশাল শাল-গজারির বন। দেখে মনে হয়, বনের গাছগুলোয় কেউ যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে রং করেছে। সেখানকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ফরহাদ হোসেন বলেন, মার্চ-এপ্রিলজুড়ে বনে যেন বসন্তের উৎসব চলে। এমন হলদে সাজ অন্য কোথাও দেখা যায় না। এ সৌন্দর্য ভাওয়াল বনাঞ্চলের অহংকার।

স্থানীয় পর্যটক শফিক কামালের কাছে পাওয়া গেছে ভাওয়াল বনাঞ্চলের কিছু বিচিত্র ফুলের নাম। তিনি বলেন, এসব বনে শাল-গজারি ফুল ছাড়াও দেখা মেলে ছটি ফুল, লজ্জাবতী, শিয়ালমতি, দাঁতরাঙা, ফাটা গুটাসহ আরও নানা ধরনের ফুল।

প্রকৃতির এত সব জমকালো আয়োজনের মধ্যেও দুঃসংবাদ আছে ভাওয়াল বনের জন্য। প্রতিবছর বসন্তে পাতা ঝরে পড়লে অনাকাঙ্ক্ষিত আগুনে পুড়ে যায় বনের ভেতর থাকা ছোট ছোট লতাগুল্ম। মানুষের অবহেলার আগুনে পুড়ে মরে বনের ভেতর থাকা ছোট ছোট সরীসৃপ।

বনের পাশের বেশ কয়েক বাসিন্দা বলেছেন, এসব আগুনের প্রভাবে পাখিরা বাসা ছেড়ে পালিয়ে যায়। বন বিভাগ স্বল্প জনবল নিয়ে এখনো পর্যন্ত এসব আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষকে সচেতন করা ছাড়া বনের ভেতর আগুন নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।