‘ভালো আছি, সুখে আছি’

সুপারি বিক্রেতা মাহবুব সরদার
ছবি: প্রথম আলো

‘সৎপথে, সৎভাবে চলতে পারছি। ভালো আছি, সুখে আছি।’ কথাগুলো একজন ভ্রাম্যমাণ সুপারি বিক্রেতার। নাম মাহবুব সরদার। ৫৪ বছরের জীবনে কোনো কিছু নিয়ে অতৃপ্তি নেই তাঁর। পরনে লুঙ্গি, মুখে লম্বা কাঁচাপাকা দাড়ি। হাসিমাখা মুখে সাইকেলের দুই হাতলে ঝুলানো সুপারিভর্তি দুটি ব্যাগ নিয়ে ছুটে চলেন গ্রাম থেকে শহরে, দোকান থেকে দোকানে।

মাহবুবের বাড়ি খুলনার রূপসা উপজেলার ঘাটভোট ইউনিয়নের পুটিমারি গ্রামে। বাবার দেখানো পথ ধরেই সুপারির ব্যবসায় নামা। সারা বছর বাগেরহাটের যাত্রাপুর, ফকিরহাট থেকে এবং ভরা মৌসুমে এসব জায়গার পাশাপাশি রূপসার বিভিন্ন গ্রাম থেকে সুপারি কেনেন। এসব এলাকার সুপারি আকারে বড়, স্বাদও ভালো। বিক্রি করেন খুলনা শহরে।

সম্প্রতি শহরের বয়রা মহিলা কলেজ মোড় এলাকায় মাহবুবের সঙ্গে কথা হয়। কথায় কথায় জানা গেল, গ্রামের মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ ঘরের সন্তান মাহবুব। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার গণ্ডি গ্রামের স্কুলের দশম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে নিজেদের খেতে ফসল ফলানো, মাছ চাষ—এসব কাজে মনোনিবেশ করেন। একসময় জড়িয়ে যান পৈতৃক পেশায়।

মাহবুব সরদার বলেন, ‘ক্লাস টেনে ওঠার পর পড়ার ভাগ্য মিলাতি পারিনি। আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। জমিজমা, মাছের ঘের দেখাশোনা করতাম। বাপ দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা করে গেছে। বাপ চলে গেছেন। এরপর আমি এই লাইনে আসছি। এই ব্যবসায় নামছি ২৩-২৪ বছর হয়ে গেল। শহরের বিভিন্ন এলাকার দোকানে দোকানে সুপারি দিই। বয়রা বাজার ও এই এলাকার দোকানগুলোয় আমার সুপারি বিক্রির মূল জায়গা।’

মাহবুবের বাবাও প্রথম বয়রা এলাকাতেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের গ্রামের পাঁচ-সাতজন আছেন এ ব্যবসায়। তবে তাঁর বাবা সবচেয়ে পুরানো ব্যবসায়ী ছিলেন।

বেচাবিক্রি নিয়ে আলাপে মাহবুব বলেন, ‘মালের দাম বাড়ায় একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। বেচাবিক্রি কমে গেছে। মোট কথা সব জিনিসের দাম বাড়ায় মানুষ একটু দম খেয়ে গেছে। বাইরে ঘুরে বুঝতে পারি, সবাই কঠিন সময় পার করছে। এক বছর আগে যে দামে তেল খেয়েছে, সেই তেল দ্বিগুণের বেশি দিয়ে কিনতে হয়। মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করছে। দিন দিন যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে—এই দুর্ভাবনায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।’

মাহাবুব বলেন, বাড়িতে পোষা গরুর যত্নআত্তি করে সাইকেলে সুপারি নিয়ে বের হন শহরের উদ্দেশে। খুব সকালে শহরে এসে বেচাকেনা শেষ হতে ঘণ্টাদুয়েক লাগে। তবে দোকানদারের কাছ থেকে টাকা হাতে পেতে বেশখানিকটা দেরি হয়ে যায়। সব মিলিয়ে বেলা একটার মধ্যে বাড়ি ফেরেন। বিকেলটা সুপারি কেনা বা এ–সংক্রান্ত কাজে ব্যয় হয়।

মাহবুবের পাঁচজনের সংসার। সুপারির ব্যবসা থেকে মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা লাভ হয়। সুপারি কিনে বাছাই করে বড়, মাঝারি ও ছোট—তিন ক্যাটাগরি বানান মাহবুব। একেক ক্যাটাগরির সুপারি একেক রকম দামে বিক্রি করেন।

প্রতিদিন কতগুলো সুপারি আনেন আর বিক্রি করেন, জানতে চাইলে মাহবুব বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন আট কুড়ি আনি। চাহিদা থাকলে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৩ কুড়ি আনি। এর বেশি সাইকেলে আনা সম্ভব হয় না। একেক দোকানদার একেক পরিমাণে নেন। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, সব মিলিয়ে কতটুকু সুপারি আনতে হবে।’ কুড়ির হিসাব পরিষ্কার করে তিনি বলেন, এক কুড়ি মানে ২০টা নয়। এক কুড়ি মানে ৬৬ গন্ডা। প্রতি গন্ডায় ৪টি হিসাবে এক কুড়িতে থাকে ২৬৪টি।

মাহবুবের সঙ্গে আলাপে মনে হবে সুখ নামের সোনার হরিণের নাগাল তিনি পেয়েই গেছেন। মুখে প্রশান্তি নিয়ে মাহবুব বলেন, ‘জীবনে যা পেয়েছি, তাতেই আমি খুশি। খুব সুখে আছি। দুই সন্তান পড়াশোনা করছে। সংসারে মায়ের মতো বটগাছটা আছে। বাড়িতে জমি-জিরেত যতটুকু আছে, তাতে বছরে কোনো কিছু কিনে খাওয়া লাগে না। আর এই ব্যবসাটাও অনেক ভালো। হারামের কোনো কারবার নেই। একেবারে স্বচ্ছ ব্যবসা।’