রাজশাহীর বাগমারায় সড়ক দুর্ঘটনায় গত ২৪ আগস্ট দুজন নিহত হন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের দুজনের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এই টাকা তিনি ব্যয় করেছিলেন উপজেলা প্রশাসনের অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের খাত থেকে। যদিও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ট্রাস্টি বোর্ড থেকে অনুদান পেতে পারেন। যার পরিমাণ ১থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
আজ বুধবার সকালে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত সভায় এক সভায় বিষয়টি উঠে আসে। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএর রাজশাহী সার্কেল এ সভার আয়োজন করে।
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে বা আহত হলে বিআরটিএর ট্রাস্টি বোর্ড থেকে ২০২৩ সাল থেকে এই ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেওয়া হয় ৫ লাখ টাকা। আর আহত বিবেচনায় দেওয়া হয় ১–৩ লাখ টাকা। এই টাকা দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করে প্রথম সুপারিশটি করে থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। উপজেলা পর্যায় থেকে আহত-নিহত ব্যক্তিদের তথ্য জেলা প্রশাসককে পাঠানো হবে। তারপর ট্রাস্টি বোর্ডে যাবে।
তবে বিষয়টি নিয়ে প্রচারণা না থাকায় অনেকেই জানেন না। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবার ক্ষতিপূরণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, ক্ষতিপূরণ চালুর পর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন মাত্র ১ দশমিক ৪২ শতাংশ ব্যক্তি। অথচ ক্ষতিপূরণের তহবিলে এখনো আড়াই শ কোটি টাকার বেশি জমা আছে।
রাজশাহীতে নিরাপদ সড়ক দিবসের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে এই অনুদানের ব্যাপারে কথা বলেন বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ। তিনি অনুষ্ঠান থেকেই বাগমারার ইউএনওকে ফোন করতে বলেন। জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা ইউএনও মাহবুবুল ইসলামকে ফোন করে বিভাগীয় কমিশনারকে কথা বলতে দেন। বিভাগীয় কমিশনার মুঠোফোনে লাউডস্পিকার দিয়ে সেটি মাইক্রোফোনের সামনে ধরে কথা বলেন।
এ সময় বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘মাহবুবুল ইসলাম, তোমার ওইখানে মাস দুয়েক আগে যে একটা অ্যাকসিডেন্টে মা মারা গেল দুইটা বাচ্চা রেখে, সেখানে গেছিলা তুমি সেই বাড়িতে?’ ইউএনও বলেন, ‘জি স্যার।’ কমিশনার জানতে চান, ‘সেই বাচ্চাদের অবস্থা কী?’ ইউএনও বলেন, ‘বাচ্চাদের অবস্থা এখন ভালো স্যার। আর দুইজনকে স্যার ৫০ হাজার ৫০ হাজার করে ১ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।’ বিভাগীয় কমিশনার জানতে চান, ‘এই টাকা তুমি কই পাইলা?’ ইউএনও জানান, উপজেলা পরিষদের অপ্রত্যাশিত ব্যয় থেকে এটা দেওয়া হয়েছে।
এরপর বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘বিআরটিএর যে এই ধরনের অনুদানের খাত রয়েছে, এটা তুমি জানো?’ এ সময় কিছুটা থেমে ইউএনও বলেন, ‘জি স্যার, এইটা জানা ছিল না আমার।’ বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘এইটা তুমি জানো না, এইটা কেউই জানে না। এখন আমরা বিআরটিএর অনুষ্ঠান থেকে তোমাকে ফোন দিছি। সমস্ত সাংবাদিক ভাইয়েরা আছেন। মালিক সমিতি, আমাদের বিভিন্ন ধরনের লোকজন আছে। বিআরটিএতে এই ধরনের ফান্ড (তহবিল) করা হয়েছে। যদি কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তাঁর পরিবার ৫ লাখ টাকা পাবে। কেউ আহত হলে সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পাবেন। অতএব তুমি ওই পরিবারকে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করার জন্য বলো। আর যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, জেলা প্রশাসনকে বলছি, সকল কেস (ঘটনা), কোনো কেস যেন বাদ না পড়ে—সবাই আবেদন করবে।’
এ সময় ওই বিভাগীয় কমিশনার সভায় উপস্থিত বাসচালক, চালকের সহকারী, শ্রমিকনেতা ও পরিবহনমালিকদের কাছে জানতে চান, তাঁরা এই অনুদানের বিষয়ে কিছু জানেন কি না। এ সময় বেশ কয়েকজন ব্যক্তি উচ্চ স্বরে বলেন, তাঁদের জানানো হয়নি।
বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ জানান, সড়ক দুর্ঘটনার এক মাসের মধ্যে অনুদানের জন্য আবেদন করতে হয়। তবে এক মাস নয়, রাজশাহীতে যেন এক বছর পর্যন্ত আবেদন নেওয়া হয়, সেই নির্দেশনা দেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি বিআরটিএর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান।
সভায় রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম (হেলাল) বলেন, ‘প্রতিটি গাড়ির যখন আমরা ফিটনেস সনদ নিই, তখন কিন্তু এই টাকা আমাদের মালিকদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। প্রতিটি গাড়ির জন্য ১ হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকাটা সবাইকে দেওয়ার জন্য আমরা খুব আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি। কিন্তু ওনাদের প্রচারটা খুব কম। অনেক মানুষ জানেই না, কীভাবে কার কাছে আবেদন করবে। এখন সবাই জানলেন।’ এক বছর পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তিনি বিভাগীয় কমিশনারকে ধন্যবাদ জানান।
সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার। এর আগে দিবসটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। এতে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান, বিআরটিএর রাজশাহী সার্কেলের সহকারী পরিচালক ফয়সাল হাসানসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা অংশ নেন।