জমিতে লবণাক্ততা বাড়ার শঙ্কা
‘এবার ঘূর্ণিঝড় রিমালে যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, তার পানি এতটাই লবণাক্ত ছিল যে মুখে নেওয়ার মতো না। চার দিন এই পানিতে প্লাবিত হয়েছে ফসলি জমি। জানি না এখন জমিতে আর ফসল ফলাতে পারব কি না। এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’ বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া গ্রামের সফল কৃষি উদ্যোক্তা শাহাদাত হোসেন গত সোমবার এমন উদ্বেগের কথা শোনালেন।
এই এলাকার ফসলি জমি আগে থেকেই বেশ লবণাক্ত। বছরে একটিমাত্র ফসল আমন করা যেত। কিন্তু উৎপাদন ছিল খুব কম। শাহাদাত হোসেন এই জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে প্রথমে সবজির আবাদ করে সফল হয়েছিলেন। তাঁর দেখাদেখি এখানে এখন ৪০০ কৃষক প্রায় ৪০ হেক্টরে এই পদ্ধতিতে সবজি আবাদ করে স্বাবলম্বী। চলতি বছর এখান থেকে উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে তাঁরা ৭ কোটি টাকা আয় করেছেন। রিমালের তাণ্ডবে তাঁদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা না থাকলেও লবণাক্ততা নিয়ে তাঁরা সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। শুধু এই এলাকাই নয়, বরিশাল বিভাগের সব জায়গায়ই কৃষকদের মধ্যে এই উদ্বেগ রয়েছে।
বরিশাল কৃষি বিভাগের হিসাবে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ১২ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে বরিশাল বিভাগের ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৩৭ হেক্টর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। এতে এ অঞ্চলের কৃষিজমির লবণাক্ততার মাত্রা আরও অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর এ অঞ্চলে নদ-নদীর জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এবং ঘন ঘন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিপুল আয়তনের জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় এসব জমি সারা বছর ফসল আবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঘূর্ণিঝড় রিমালে জলোচ্ছ্বাস নতুন করে উদ্বেগে ফেলেছে কৃষক ও সংশ্লিষ্টদের।
জরিপে লবণাক্ততার চিত্র
কয়েক বছর ধরে বৃষ্টিপাত কম হওয়া, উজানের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের নদ-নদীতে উজানের প্রায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভয়াবহ লবণাক্ততা ছড়িয়েছে। এই লবণপানি এবারের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১২ ফুট উঁচু জোয়ারে ফসলি জমি এমনকি মানুষের বসতিকে প্লাবিত করেছে দফায় দফায়। ফলে এবার লবণাক্ততা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এবং লবণাক্ত জমির পরিধি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষক ও বিশেষজ্ঞরা।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) দেশে মাটি ও পানির প্রথম জরিপ চালায় ১৯৭৩ সালে। ওই জরিপে দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় ১৮টি জেলায় ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ত। প্রথম জরিপের ২৭ বছর পর ২০০০ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় জরিপ পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি।
মৃত্তিকা ও পানি লবণাক্ততা জরিপ-২০০০-এ দেখা যায়, লবণাক্ত জমি বেড়ে হয় ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ত জমি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টরে। অর্থাৎ গত ৩৬ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২০ সালে চতুর্থ জরিপ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে তা হয়নি।
২০০৯ সালে করা জরিপে, বরিশাল বিভাগে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমি অতিলবণাক্ত ছিল। এসব জমিতে লবণের পরিমাণ সময়বিশেষে ১৬ থেকে ২৮ দশমিক ৫ ডেসিসিমেন পার মিটার (ডিএস/এম) পর্যন্ত। চাষাবাদের জমিতে লবণসহনশীলতার সর্বোচ্চ মাত্রা ৪ থেকে ৮ ডিএস/এম।
ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল অঞ্চলে লবণাক্ততার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বরগুনা। এ জেলার ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮০ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৯৫ হাজার ৬২০ হেক্টর জমি লবণাক্ত। এর পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী। এ জেলার ৩ লাখ ৭ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমির মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৮০ হেক্টর জমি লবণাক্ত। এরপর পর্যায়ক্রমে ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি জেলা ছিল।
বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলিমুর রহমান বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও এ অঞ্চলের বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা—এই চার জেলার মাটি ও পানিতে বেশি লবণাক্ততা ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে বরিশালের মাটি ও পানিতেও লবণাক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের গবেষণা প্লট বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলায় সম্প্রতি আমরা উচ্চমাত্রার লবণাক্ততার উপস্থিতি পেয়েছি। এটা আমাদের জন্য অ্যালার্মিং। আর রিমালে যে জলোচ্ছ্বাস আমরা দেখেছি তাতে এ অঞ্চলে লবণাক্ততা আরও সম্প্রসারিত হবে, এতে সন্দেহ নেই। এতে এ অঞ্চলের কৃষি আরও হুমকিতে পড়বে।’
এই কৃষিবিজ্ঞানী বলেন, একবার কোনো জমি লবণাক্ত হয়ে পড়লে তা যত ব্যবস্থাপনা করা হোক না কেন তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না।
বরিশাল মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের মাটি এবং নদ-নদীর পানিতেই নয়। ভূগর্ভস্থ জলের আধারেও মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
গত মার্চে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার গভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করে শূন্য দশমিক ৯১ ডিএস/এম, বরগুনার তালতলী উপজেলার নলকূপের পানিতে ১ দশমিক ৯০ ডিএস/এম, আমতলী উপজেলার নলকূপের পানিতে শূন্য দশমিক ৯০ ডিএস/এম, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার গভীর নলকূপের পানিতে ১ দশমিক ৫০ ডিএস/এম, পাথরঘাটার নাচনাপাড়া এলাকার গভীর নলকূপে ৩ দশমিক ৫০ ডিএস/এম লবণাক্ততার উপস্থিতি পান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা।
একইভাবে গত ১৯ মে এ অঞ্চলের সাতটি নদীর পানি পরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে বলেশ্বর, পায়রা, গলাচিপা, আন্ধারমানিক—চারটি নদীর পানিতে অসহনীয় লবণাক্ততার উপস্থিতি পেয়েছেন। এই মাত্রা শূন্য দশমিক ৮১ থেকে ১১ দশমিক ৫৬ ডিএস/এম পর্যন্ত।
বরিশাল আঞ্চলিক মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এফ এম মামুন প্রথম আলোকে বলেন, পানির সহনীয় লবণাক্ততার মাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিএস/এম হলেও বরগুনা ও পটুয়াখালী দুই জেলায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি লবণাক্ততার উপস্থিতি পাওয়া গেছে ভূগর্স্থ ও নদ-নদীর পানির উৎসে।
করণীয় কী?
এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী? এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল কৃষি ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে। তাঁরা এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মতামত দিয়েছেন। এর মধ্যে বাঁধগুলো উঁচু করা, খালগুলো দখলমুক্ত করে খনন করা, স্বাদুপানি সংরক্ষণে উদ্যাগী হওয়া এবং লবণসহিষ্ণু আরও নতুন জাত উদ্ভাবন করা উদ্যোগ নেওয়া।
এ প্রসঙ্গে মো. আলিমুর রহমান বলেন, পোল্ডারগুলো নাজুক এবং পুরোনো। তাই উঁচু জোয়ারে এসব বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া পুকুরগুলো সংরক্ষণ করে স্বাদুপানির সংরক্ষণ করে মজুত বাড়াতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গাজীপুরের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ) প্রিয়লাল চন্দ্র পাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, জলোচ্ছ্বাসে মাটি-পানির ক্ষতি করবে, এটা ঠিক। তবে এর সঙ্গে যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, তাতে লবণ দ্রবীভূত হয়ে একটা ভারসাম্য এনেছে। আর এই পানি নেমে যাওয়ার সময় অধিকাংশ দ্রবীভূত লবণ সঙ্গে নিয়ে গেছে। তাই এটা নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই। তবু আমরা মাঠপর্যায়ে গবেষণা করব, পরিস্থিতি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা বোঝার জন্য।