১২ ঘণ্টা পর নিভল কেরানীগঞ্জের বহুতল ভবনের আগুন
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ‘জাবালে নুর টাওয়ার’ নামের বহুতল ভবনে লাগা আগুন ১২ ঘণ্টা পর নির্বাপণ করা হয়েছে। ভোর চারটার দিকে লাগা আগুন ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটের চেষ্টায় নেভে সন্ধ্যা ছয়টায়। তবে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ওই ভবনে বসবাসরত ৪৫ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আগানগর এলাকায় বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুসংলগ্ন (বাবুবাজার সেতু) ওই ভবনের ভূগর্ভস্থ কাপড়ের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে প্রথমে কেরানীগঞ্জ, সদরঘাট, লালবাগ, মিরপুর, সিদ্দিকবাজারসহ ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। তবে আগুন নেভাতে বেগ পাওয়ায় দুপুর ১২টার দিকে আরও ছয়টি ইউনিটসহ মোট ২০টি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রমে অংশ নেয়।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ভোর ৫টা ৩৭ মিনিটে আগুনের খবর পাওয়ার পর আট মিনিটের মধ্যেই প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে। পরে অন্যান্য ইউনিট যুক্ত হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (গণমাধ্যম) শাহজাহান শিকদার জানান, গুদাম ও দোকানগুলোর তালা, শাটার ও কলাপসিবল গেট কেটে আগুন নেভাতে হচ্ছে। ভেতরে বিপুল পরিমাণ কাপড় ও দাহ্য সামগ্রী থাকায় এবং ঘন ধোঁয়ার কারণে অগ্নিনির্বাপণে বেগ পেতে হয়েছে। ভবন থেকে ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভবনটির মালিক হলেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা জাতীয় পার্টির সভাপতি মো. ফারুক হোসেন এবং আবাসন ব্যবসায়ী নুরে আলম। ৪২ শতাংশ জমির ওপর জাবালে নুর টাওয়ারটি সাতটি পৃথক ভবনের সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু এগুলোর বেজমেন্ট (ভিত্তিমাত্র) একটি। ভবনের ভূগর্ভস্থ, প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ঝুট কাপড়ের গুদাম ও দোকান রয়েছে। তৃতীয় তলা থেকে দশম তলা পর্যন্ত আবাসিক ফ্ল্যাট। অভিযোগ রয়েছে ভবনটি নির্মাণের সময় যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। এ ছাড়া ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ও জরুরি বহির্গমনের (ইমার্জেন্সি এক্সিট) কোনো ব্যবস্থাও ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ভবনের ভূগর্ভস্থলে ঝুট কাপড়ের গুদামের এক ভাড়াটে বলেন, ‘তিন বছর আগে মাসে ২০ হাজার টাকায় ফারুক হোসেনের কাছ থেকে একটি গুদাম ভাড়া নিই। আজকের আগুনের ঘটনায় আমার গুদামের সব মালামাল পুড়ে গেছে। এতে আমার প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আজ দুপুরে কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আফতাব আহমেদকে আহ্বায়ক করা হয়। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. উমর ফারুক বলেন, ভবনটি অনুমোদনহীন। তাঁদের গাফিলতি ও অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। অগ্নিকাণ্ডে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সহায়তা করা হবে।
জাবালে নুর টাওয়ার ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জোন-৭–এর আওতাধীন। এ জোনের ইমারত পরিদর্শক বিটু কুমার বলেন, ‘আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আগামীকাল রোববার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী জাবালে নুর টাওয়ারের ব্যাপারে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ভবন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগে মালিক ফারুক হোসেন ও নুরে আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাঁরা বারবার সংযোগ কেটে দেন।
‘জ্যান্ত মানুষ কবরে আশ্রয় লইছি’
আগুন লাগার পর ভবনের বাসিন্দারা পার্শ্ববর্তী আগানগর উঁচু কবরস্থান, আগানগর ইউনিয়ন পরিষদ ও আগানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেন।
কথা হয় জাবালে নুর টাওয়ার ভবনের সপ্তম তলার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রাশিদা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, আগুন থেকে বাঁচতে ভোরবেলায় ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে পরিবারের সদস্য ও পাশের ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দারা নিকটবর্তী কবরস্থানে আশ্রয় নেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘মানুষ মইরা গেলে দাফনের লাইগ্যা কবরে নিয়া আহে, আর আমরা আগুন থেইক্যা বাঁচতে জ্যান্ত মানুষ কবরে আশ্রয় লইছি।’
পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে রাশিদা বেগম বলেন, ‘রাত চাইরটার পর আমগো লগের ফ্ল্যাটের মানুষজনের চিল্লাচিল্লি হুইনা জাইগা উঠি। পরে ঘর থেইক্যা বাহির হইয়া দেহি উনারা দৌড়াদৌড়ি করতাছে। একটু পর দেহি লিফটের নিচ থেইক্যা ধোঁয়া আইতাছে। তহন আমরা পোলা-মাইয়া, নাতিগো লইয়্যা দৌড়াইয়া কোনোরকম নিচে নাইমা আহি। নিচ থেইক্যা দেহি, বিল্ডিংয়ে ধোঁয়া আর আগুন খালি বাড়তাছে। পরে জান বাঁচাইতে বাড়ির লগের আমবাগিচা কবরস্থানে আইসা জীবন বাঁচাই। আমগো লগে লগে তহন আরও মানুষ কবরস্থানে আশ্রয় লইতে আহে। কিন্তু কবরস্থান তহন পুরা আন্ধার আছিল। কবরের মাঝ জায়গায় শুধু দুইটা বাতি আছিল। ওই আলোতে আমরা কোনোরকম ভোরডা পার করছি।’
আগানগর উঁচু কবরস্থান ফটকে আশ্রয় নেওয়া ভবনের চতুর্থ তলার বাসিন্দা মো. আলেক চান বলেন, ‘২০১৭ সালে জাতীয় পার্টির নেতা ফারুকের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনে বসবাস শুরু করি। ভবন কেনার সময় ফারুক বলেছিল, ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে গাড়ির গ্যারেজ হবে। কিন্তু পাঁচ বছর আগে সে কথার বরখেলাপ করে অন্যায়ভাবে গ্যারেজের জায়গায় ঝুট কাপড়ের গুদাম হিসেবে ভাড়া দেয়। গুদাম ভাড়া না দিতে ফারুক ও নুরে আলমকে একাধিকবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা কর্ণপাত করেনি। যদি তারা এ অন্যায় কাজটি না করত, তাহলে আজ আমাদের জীবন হুমকিতে পাড়ত না। তাদের কারণে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি হতে পারত।’
ধোঁয়া দেখতে পেয়ে স্ত্রী ও চার মাসের সন্তানকে নিয়ে আশিকুজ্জামান ভবন থেকে দৌড়ে নিচে নেমে আসেন। তিনি বলেন, ‘ধোঁয়া দেখে আঁতকে উঠি। চার মাসের সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভবন থেকে দৌড়ে নিচে নামি। পরে পার্শ্ববর্তী আগানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিই।’