ভেতরে চলল পাবলিক পরীক্ষা, বাইরে উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে সমাবেশ

একপাশে চলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পরীক্ষা, আরেক পাশে চলছে মাইক বাজিয়ে সমাবেশ। বুধবার দুপুরে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে মোরেলগঞ্জের সরকারি সিরাজ উদ্দিন মেমোরিয়াল (এসএম) কলেজে
ছবি: প্রথম আলো

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলাকালে কলেজমাঠে মাইক বাজিয়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় উপকারভোগীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনে এই সমাবেশ আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের ব্যানারে আয়োজক হিসেবে ছিল ‘উপজেলা পরিষদ’-এর নাম। এই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আমিরুল আলম। ওই ব্যানারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম তারেক সুলতানের নাম উল্লেখ থাকলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না।

পরীক্ষা বিধিমালা ভঙ্গ করে উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে সমাবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও তারেক সুলতান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওইভাবে জানি না। ব্যানারে আমার নাম থাকার কথা নয়। কারা ব্যানার বানিয়েছে, জানি না। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ওখানে সভাপতিত্ব করছেন। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে মাইক বন্ধ করতে বলা হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর অনুষ্ঠান করার জন্য বলা হয়েছে।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনার বিভাগের পরীক্ষা ছিল আজ বুধবার। মোরেলগঞ্জের সরকারি সিরাজ উদ্দিন মেমোরিয়াল (এসএম) কলেজ একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে বেলা একটায় পরীক্ষা শুরু হয়ে শেষ হয় বিকেল পাঁচটায়। এদিকে এই কলেজ মাঠে সমাবেশে অংশ নিতে বেলা তিনটা থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রকল্পের উপকারভোগী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আসতে থাকেন। বাজতে থাকে উচ্চ শব্দে মাইক, চলে স্লোগান। বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে মাঠে সমাবেশ মঞ্চের সামনের চেয়ারগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পুলিশও উপস্থিত ছিল। ‘নৌকা’ ‘নৌকা’ স্লোগান দিয়ে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে লোকজন আসতে থাকেন মাঠে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী, পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষার্থী ও পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি যেন কেন্দ্রপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে না পারেন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। বিধিমালার ১৯ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে, জেলা প্রশাসক সব পরীক্ষাকেন্দ্রে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা বিধান করবেন। পরীক্ষা পরিচালনার সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট জেলা সদরের বাইরে অবস্থিত পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে তাঁর প্রতিনিধি (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মর্যাদাসম্পন্ন) নিয়োগ করতে পারবেন।

পরীক্ষার কারণে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে শেষের দিকে শব্দহীন করে দুই-তিনজনের বক্তব্য দিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার কোনো সমস্যা হয়নি। পরীক্ষার হল ছিল মঞ্চ থেকে অনেক দূরে এবং সংসদ সদস্য নিজে হলে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
মো. মোজাম্মেল হক, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, মোরেলগঞ্জ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কেন্দ্রের দুজন পরীক্ষার্থী বলেন, ‘এত শব্দের মধ্যে কখনো পরীক্ষা দিইনি। হলের পাশেই বড় মাইকের আওয়াজে মনোযোগ নষ্ট হয়। এমন পরিবেশে পরীক্ষা যন্ত্রণার।’

এ বিষয়ে আজ বেলা ৩টা ৫৭ মিনিটে জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছেন। পরে বিকেল ৪টা ৩৭ মিনিটে জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, কলেজ অধ্যক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, তিনি পরীক্ষার বিষয়টি কেন আগে জানাননি। মাইক বন্ধ করা হয়েছে। পরীক্ষাটি কোনার একটি কক্ষে নেওয়া হচ্ছে এবং ওই এলাকায় কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

পরীক্ষাকেন্দ্রের মাঠে তখনো মাইক বন্ধ হয়নি জানালে জেলা প্রশাসক মাইক বন্ধ হয়েছে দাবি করে আবারও খোঁজ নিতে বলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে ওই কলেজের এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাবেশ তো চলছে, মাইকও বাজছে, ভেতরে পরীক্ষাও হচ্ছে। আসলে এমন তো হওয়ার কথা নয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা ও পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত। এমন কখনো দেখিনি। এক পাশে পরীক্ষা চলছে, মাঠে মাইক বাজিয়ে শত শত লোক নিয়ে সমাবেশ—এটা কি কখনো হয়? কীভাবে কী সম্ভব, আমি ঠিক জানি না, স্যার হয়তো বলতে পারবেন।’

বিকেলে ৪টা ৫৫ মিনিটে এসএম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তখন তিনি কলেজেই ছিলেন দাবি করেন। পাশ থেকে ভেসে আসছিল মাইকের প্রচণ্ড শব্দ। পরীক্ষাকেন্দ্রের মাঠে সমাবেশ হতে পারে কি না, জানতে চাইলে অধ্যক্ষ হাফিজুর বলেন, ‘এটা আমরা বলতে পারব না। আমাদের প্রোগ্রাম (পরীক্ষার সময়সূচি) সব জায়গা দেওয়া আছে। এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না।’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজক কারা, জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমরা জানি না, কারা কী করেছে কোনো মন্তব্য নেই। অনুমতি সেইভাবে নেয়নি। আমরা পরীক্ষা ম্যানেজ করছি। আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি।’

মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে এমপি ছাড়াও মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এমদাদুল হক, মোরেলগঞ্জ পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিরুল হক তালুকদারসহ জেলা, উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দেখা গেছে।

অনুষ্ঠানটির আয়োজক উপজেলা পরিষদ দাবি করে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হক বলেন, সরকারের যত উপকারভোগী, সবাইকে নিয়ে এই আয়োজন ছিল। এতে উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ১৫ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। পরীক্ষার কারণে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে শেষের দিকে ‘শব্দহীন’ করে দুই-তিনজনের বক্তব্য দিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার কোনো সমস্যা হয়নি। পরীক্ষার হল ছিল মঞ্চ থেকে অনেক দূরে এবং সংসদ সদস্য নিজে হলে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।