মৌলভীবাজারে ভোরের দু-তিন ঘণ্টার জমজমাট হাট
মৌলভীবাজার শহর তখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। এর মধ্যে শহরের একটি অংশে কুয়াশার চাদর, রাত জাগার ক্লান্তি মুছে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন একদল মানুষ। তাদের ছোটাছুটিতে স্থানটি ক্রমে সরগরম হয়ে উঠছে। ছোট-বড় গাড়ি আসছে, মালামাল ওঠানো-নামানো হচ্ছে।
মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজারের বেরিরপাড় এলাকায় সবজির আড়তের দৃশ্য এটি। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেমন নানা রকম মৌসুমি ও আগাম সবজি আসে; তেমনি স্থানীয় কৃষক, কৃষি-উদ্যোক্তারাও সরাসরি শাকসবজি এখানে এনে বিক্রি করেন। দুই থেকে তিন ঘণ্টার হাটটি তখন অনেক মানুষের কথায়, ছুটে চলায় মুখর থাকে।
সোমবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বেরিরপাড়ের সবজির আড়তে গিয়ে দেখা গেল, তখনো স্থানটি পুরো জমে ওঠেনি। ফেরিওয়ালাদের ভ্রাম্যমাণ ভ্যানের বেশির ভাগই খালি দাঁড়িয়ে আছে। কেউ হাতে খালি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ এদিক-ওদিক খোঁজ নিচ্ছেন। দাম–দর জানার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বেলা কিছুটা গড়াতেই স্থানটি অনেক মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ ভ্যানসহ ছোট-বড় গাড়ি এসে ভিড় করতে থাকে। শ্রমিকেরা সবজির বস্তা ও টুকরি নামাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
বিক্রেতাদের মধ্যে সরাসরি কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তা আছেন। আছেন পাইকারেরাও, যাঁরা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে এসেছেন। এখানে খুচরা বিক্রেতার কাছে পাল্লা হিসাবে বিক্রি করছেন। প্রতি পাল্লায় থাকছে পাঁচ কেজি। এর নিচে বিক্রি হচ্ছে না। নিলে পাঁচ কেজি করেই নিতে হয়, এটা নিয়ম। ক্রেতাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা শহরের বিভিন্ন খুচরা বাজারে পণ্য নিয়ে বিক্রি করবেন। আছেন শহরতলির বিভিন্ন হাটের খুচরা বিক্রেতা। মুহূর্তেই জমে ওঠে স্থানটি।
শাকসবজি ও বিভিন্ন ধরনের পণ্য কিনে কেউ বস্তায় ভরছেন, আবার কেউ ভ্যানের মধ্যে নিয়ে সাজাচ্ছেন। কেউ রিকশা বা ভ্যান ভাড়া করে পণ্য নিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছেন। নতুন আসা কোনো পণ্য দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আড়তে যত সময় মালামাল বেচাকেনা চলে, তত সময় কিছু ভ্রাম্যমাণ চা-স্টল ও ছোলা-আখনির দোকান বসে।
কিশোরগঞ্জের ফারুক মিয়া প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে মৌলভীবাজার শহরে ভ্যানে করে ফেরি দিয়ে সবজি বিক্রি করেন। পাইকারি দরে কেনা সবজি দিয়ে ভ্যান সাজানোর সময় বলেন, ‘আমি হেঁটে হেঁটে সবজি বেচি। তবে এখন সবজির অনেক দাম। বেচতে অনেক কষ্ট হয়।’
জলপাই নিয়ে এসেছেন মৌলভীবাজার শহরতলির বর্ষিজোড়ার মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, তিনি বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই এই আড়তে বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আসা-যাওয়া করছেন। তিনি শুধু জলপাই নিয়ে এসেছেন। পাইকারি ৫০ টাকা কেজি দরে জলপাই বিক্রি করছেন। তিনি গ্রামের বিভিন্নজনের কাছ থেকে ৮-১০টি গাছের জলপাই কিনেছেন। এখন সেই জলপাই এনে আড়তে বিক্রি করছেন।
কৃষি উদ্যোক্তা আরিফ নূর টমেটো ও শসা নিয়ে বসে ছিলেন। তিনি গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করেছেন। এই টমেটো আগাম বাজারে এসেছে। তিনি বলেন, ৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি টমেটে বিক্রি হচ্ছে।
কাঁচা মরিচ ও লেবু বিক্রেতা শুকুর আলী জানান, তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই আড়তে ব্যবসা করছেন। আগের দিন রাত আটটা-নয়টা থেকে ট্রাকে করে বিভিন্ন স্থান থেকে মৌসুমিসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি আসা শুরু হয়। ঢাকা, বগুড়া, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এই মালামাল আসে। সকাল পাঁচ-ছয়টা থেকে স্থানীয় বিভিন্ন এলাকার কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা ও পাইকারেরা মালামাল নিয়ে আসেন এবং কেনাবেচা শুরু হয়। সকাল আটটার মধ্যে পাইকারি মালামাল বিক্রি শেষ হয়ে যায়।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি বাড়ে, তেমনি সকাল আটটা বাজার আগেই ভিড় হালকা হতে শুরু করে। খুচরা বিক্রেতারা অন্য হাটের দিকে, গলিপথের দিকে ছুটে গেছেন। ভিড়টাও দ্রুত কমে যেতে থাকে। আড়তটাও দ্রুত ফাঁকা হয়ে যায়।