দুঃসংবাদের পাল্লাই ছিল ভারী

সব ধরনের মলিনতা ও কালিমা মুছে সিলেটবাসী নতুন বছর আরও সুন্দর এবং ভালোভাবে কাটাতে চান।

সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এবার টমেটোর ভালো ফলন হয়েছে। প্রতিদিন খেত থেকে সেই টমেটো তুলে বিক্রির জন্য বাছাই করেন চাষিরা। মানভেদে পাইকারি দরে প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। গতকাল সদরের উমাইরগাঁও এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

আর এক দিন পরেই শুরু হচ্ছে নতুন বছর। বিদায়ী বছরে সিলেট নানা কারণেই দেশব্যাপী ছিল আলোচনার বিষয়। সুসংবাদের চেয়ে দুঃসংবাদের পাল্লাই এখানে ভারী ছিল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস উত্তপ্ত ছিল। ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে মানুষ। তবে সব ধরনের মলিনতা ও কালিমা মুছে সিলেটবাসী নতুন বছর আরও সুন্দর এবং ভালোভাবে কাটাতে চান।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ

বছরের শুরুর দিকেই ১৩ জানুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন কয়েক শ ছাত্রী। ১৬ জানুয়ারি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পরে এই আন্দোলন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।

আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ, অনশন, মশালমিছিল, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশনা দিলেও শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। তাঁদের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন শুরু করেন।

দাবি আদায়ে র লক্ষ্যে ১৯ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো ধরনের খাবার না খেয়ে অনশন পালন করেন ২৭ শিক্ষার্থী। ২৫ জানুয়ারি শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হক গিয়ে দাবি পূরণের আশ্বাস দিরলে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ১১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণে আশ্বাস পাওয়ায় ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। পরে শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী উপাচার্য পুলিশি হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন।

২৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাশে গাজী-কালু টিলা লাগোয়া ‘নিউজিল্যান্ড’ এলাকায় বেড়াতে গিয়ে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদ (২২)। বুলবুল হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

বন্যায় বিপর্যয়

সিলেট প্রথম দফা বন্যার কবলে পড়ে মে মাসে। এরপর ১৫ জুন শুরু হয় দ্বিতীয় দফা বন্যা। চলে অন্তত ২০ জুলাই পর্যন্ত। এ সময় পুরো সিলেট বিভাগের চার জেলার অধিকাংশ এলাকাই পানিতে তলিয়ে যায়। তবে বেশি ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হন সিলেট ও সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা। সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ দুটো জেলার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। দিনের পর দিন অধিকাংশ এলাকার মানুষকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নেটওয়ার্কহীন কাটাতে হয়েছে। মানুষকে ভুগতে হয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে। ভেসে গেছে গবাদি পশু। দীর্ঘদিন পানিতে তলিয়ে থাকায় অসংখ্য রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে।

সিলেটে দুই দফা বন্যায় বড় সংকটে পড়ে গেছে অর্থনীতি। বোরো আর আমনের ফলন নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কৃষি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা খাতে ব্যাপক লোকসান হয়েছে।

খাবার, সুপেয় পানি ও চিকিৎসার অভাবে বন্যায় সিলেটজুড়ে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। প্রায় এক কোটি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কেউ কেউ ঘরের ভেতরে মাচা বানিয়ে থেকেছেন। তখন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিত্তবান মানুষেরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেকটাই সহজ হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।

রাজনীতিতে অস্থিরতা

বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ হয়েছে ১৯ নভেম্বর। সমাবেশ সফল করতে অন্তত এক মাসজুড়ে সিলেটজুড়ে প্রচারণা চালিয়েছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। তবে প্রচারণায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বাধা, মামলা ও গণগ্রেপ্তারের অভিযোগ করে বিএনপি। সমাবেশের আগে ছাত্রলীগ মোটরসাইকেল নিয়ে শোভাযাত্রা করলে উত্তেজনা ছড়ায়।

বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে পরিবহন ধর্মঘট আর আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি অবস্থান থাকলেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ হয়। ৬ নভেম্বর রাতে আম্বরখানা বড়বাজারে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক আ ফ ম কামাল। পরে বিএনপি অভিযোগ তোলে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সর্ম্পৃক্তরা কামালকে খুন করেছে।

এদিকে ২২ অক্টোবর সিলেট মহানগরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা-কর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে। সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেন, জাকির বিভিন্ন ওয়ার্ডে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বজনপ্রীতি করে ‘পকেট কমিটি’ তৈরি করছেন।

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই সদস্যের কমিটি গঠিত হয় ২৩ অক্টোবর। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ এ কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ করে। এসব কর্মসূচি থেকে অভিযোগ করা হয়, গঠিত কমিটির সম্পাদক হিরন মিয়া বিএনপির সাবেক নেতা। কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি।