হবিগঞ্জে দেদার বিক্রি হচ্ছে অনুমোদনহীন লটারির কুপন, ক্রেতা নিম্ন আয়ের মানুষ
প্রথম পুরস্কার ১৬৫ সিসির একটি মোটরসাইকেল, দ্বিতীয় পুরস্কার ব্যাটারিচালিত একটি ইজিবাইক, তৃতীয় পুরস্কার এক ভরির সোনার চেইন—প্রতিদিন এমন ৬১টি পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে হবিগঞ্জে বিক্রি হচ্ছে অনুমোদনহীন লটারির কুপন। প্রতিটি কুপনের দাম নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা।
হবিগঞ্জ শহরের বৃন্দাবন সরকারি কলেজসংলগ্ন নিউ ফিল্ডে শুরু হওয়া মাসব্যাপী শিল্প-বাণিজ্য মেলায় এ কুপন বিক্রি করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের অনুমোদনে জাতীয় মহিলা সংস্থা হবিগঞ্জ জেলা শাখা এ মেলার আয়োজক বলে দাবি করা হয়েছে।
তবে সংস্থার হবিগঞ্জ কার্যালয়ের জেলা কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইয়াছিন প্রথম আলোকে বলেন, এ আয়োজনের কিছুই তাঁরা জানেন না। জেলা প্রশাসক মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, মেলায় আয়োজক হিসেবে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের (জাতীয় মহিলা সংস্থার) নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা শুধু কাগজে–কলমে থাকবেন। পুরো বিষয়টি দেখাশোনা করবে জেলা প্রশাসন।
তবে জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কর্মকর্তা যে দাবি করেছেন, তা সঠিক নয়। এ বিষয়ে তাঁর চেয়ারম্যান অবগত। জাতীয় মহিলা সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন মেলার আয়োজনের জন্য আবেদন করে। জাতীয় মহিলা সংস্থাকে এ অনুমোদন দেয় জেলা প্রশাসন।
জাতীয় লটারি নীতিমালা-২০১১ এর ৩ এর (ক) অনুযায়ী, শুধু সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত সংস্থা, করপোরেশন, স্থানীয় ও সামাজিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিকবিষয়ক কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প/উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে লটারি পরিচালনার অনুমতি পেতে পারে। সে হিসেবে আইনত এভাবে কুপন বিক্রি করতে পারে না মেলা কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, মেলায় কোনো ধরনের লটারি পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। মেলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কিছু ব্যক্তি লটারি কুপন বিক্রি করছেন—এমন খবর পেয়ে তিনি তাঁদের অফিসে ডেকে তা বন্ধ করতে বলেছেন। বন্ধ না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।
২ জুন শুরু হওয়া মাসব্যাপী এ মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মেলায় প্রসাধনসামগ্রী, খাদ্যসামগ্রী, হস্তশিল্প, গৃহস্থালি পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, খেলনা, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক এবং স্টেশনারি পণ্যের স্টল রয়েছে। আরও রয়েছে সার্কাস ও পুতুলনাচসহ বিভিন্ন বিনোদনের আয়োজন। তবে নামে শিল্প-বাণিজ্য মেলা হলেও নেই কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্যাভিলিয়ন বা স্টল।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন অর্ধশত ইজিবাইক দিয়ে হবিগঞ্জ জেলা সদরসহ জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে লটারির কুপন। প্রতিদিন রাত ১০টায় মেলা প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে কুপনের ড্র হয়। এ দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষ কুপন কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন। কুপন ক্রেতাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ।
গত রোববার রাতে মেলা প্রাঙ্গণে কথা হয় হবিগঞ্জ শহরের হোটেলশ্রমিক রুবেল মিয়ার (২৪) সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিনে তিনি প্রায় এক হাজার টাকার টিকিট কিনেছেন। কিন্তু কোনো পুরস্কার পাননি।
গত সোমবার রাত ১০টায় মেলার দক্ষিণ পাশের মঞ্চে একজন উপস্থাপক লটারির কুপনের ড্রয়ের জন্য এক শিশুকে ডেকে নেন। শিশুটির তোলা কুপন দেখে মাইকে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেন উপস্থাপক। কুপন নম্বর ঘোষণার পর মঞ্চের সামনে উপস্থিত কেউ সাড়া না দিলে কুপনের পেছনে থাকা মুঠোফোন নম্বরে কল করা হয়। এরপর জানা যায়, পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তির নাম ময়না মিয়া। বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপর গ্রামে। তাঁকে মুঠোফোনে জানানোর পর তিনি রাত ১২টার দিকে এসে পুরস্কার গ্রহণ করেন।
লটারি ড্রয়ের সময় মঞ্চের বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে কুপন নম্বর মেলাচ্ছিলেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লোকড়া গ্রামের রিকশাচালক সিরাজ মিয়া (৩৪)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিনই আসেন ড্র দেখতে। আজ রিকশা চালিয়ে তিনি আয় করেছেন ৬০০ টাকা। সেই টাকা থেকে ২০০ টাকায় ১০টি টিকেট কিনেছিলেন একটি ইজিবাইক পাওয়ার আশায়। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে কোনো পুরস্কার জোটেনি। সিরাজ মিয়া বলেন, আশায় আশায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ টাকা খুইয়েছেন লটারির কুপন কেনার পেছনে।
লটারির টিকিট বিক্রির ব্যবস্থাপক আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ১০ দিন ধরে তাঁরা হবিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে ও জেলার ৯টি উপজেলায় অর্ধশত ইজিবাইক দিয়ে টিকিট বিক্রি করে থাকেন। প্রতিটি গাড়িতে গড়ে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। এ লটারি বিক্রির জন্য আলাদা কমিটি রয়েছে। কমিটির লোকজন টিকিট বিক্রির বিষয়টি দেখাশোনা করেন।
সোমবার দুপুরে হবিগঞ্জ শহরের প্রধান সড়কের পাশে একটি টেবিলে লটারির কুপন সাজিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় এক তরুণকে। তাঁকে ঘিরে ছিলেন ১০–১৫ জন মানুষ। সবাই লটারির টিকিট কিনছিলেন।
শহরের রাজনগর এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ইজিবাইকে মাইকিং করে বিক্রি হচ্ছে এসব কুপন। ৭ জুন থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয়েছে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা। অনেক পরীক্ষার্থীকেই লটারি কুপন কিনতে দেখা যাচ্ছে। অনেকের এটা নেশায় পরিণত হয়েছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সাইদুর আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসন কী করে এ কাজের অনুমোদন দেয়, তা নিয়ে আমরা এলাকাবাসী চিন্তিত।’