গবেষণা মাঠে চালকলের ছাই

চালকলের ছাইয়ে গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ।

দিনাজপুরে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠে গাছের পাতায় চালকলের ছাই পড়ছে। গত সোমবার সকালেপ্রথম আলো

দিনাজপুরে চালকলের কালো ধোঁয়া, ছাইয়ে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ও ফসলের ক্ষতির কথা বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। এবার ফসল নষ্টের অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।

চালকলের ছাইয়ে গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির ভুট্টা প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ। এতে তিনি বলেন, ‘ছাইয়ের ঘন আস্তরণ পড়ে সবুজ পাতা কালো হয়েছে। ছাইয়ের কারণে পত্ররন্ধ্র খোলা-বন্ধ হতে অসুবিধা হয়। গাছের প্রস্বেদন ও সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। পুরুষ ফুলের পরাগ রেণুর স্থায়িত্ব ও প্রজননক্ষমতা কমে যায়। স্ত্রী ফুলের মাথা থেকে বের হওয়া চুলের মতো সিল্কে ছাই পড়ার কারণে সংবেদনশীলতা কমে যায়। ফলে নিষেকের পর দানার পরিমাণও কম হয়। এ ছাড়া মাটি থেকে গাছের খাদ্য গ্রহণ কমে যাচ্ছে, ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন এবং শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।’

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাপ, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু গম ও ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এযাবৎ ভুট্টার ২৯টি নতুন জাত (২০টি হাইব্রিড, ৯টি কম্পোজিট) উদ্ভাবন করা হয়েছে। সারা দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক শূন্য ৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার ফলন হয়েছে ৬৪ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে ভুট্টার বীজের চাহিদা বাৎসরিক ১১-১২ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর বিএডিসিকে এক টন পিতৃ-মাতৃ বীজ সরবরাহ করছে। সেখান থেকে বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ কৃষক ভিত্তি বীজ উৎপাদন করছেন ৬০-৭০ টন।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র বলছে, দিনাজপুরে ১ হাজার ২০০ হাস্কিং মিল এবং ২৮০টি অটো রাইস মিল রয়েছে। যার বেশির ভাগই সদর উপজেলার পুলহাট, গোপালগঞ্জ ও রানীগঞ্জ এলাকায়। গত কয়েক দিন সদর উপজেলার নশিপুরে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠ ও মিল-সংশ্লিষ্ট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠে ভুট্টাগাছের পাতায় মিলের মিহি আকৃতির ছাই পড়ে সবুজ পাতা কালো আকার ধারণ করেছে। গোপালগঞ্জ, চেহেলগাজী, পুলহাট এলাকায় রাস্তার পাশে দেখা মিলেছে স্তূপীকৃত উন্মুক্ত ছাইয়ের ঢিবি। কুণ্ডলী পাকিয়ে মিলের চিমনি থেকে বের হচ্ছে ঘন কালো ধোঁয়া। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে বসন্তের আকাশে।

চেহেলগাজী এলাকার চালকলের এক মালিককে সড়কের পাশে খোলা জায়গায় ছাই রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমরা সকাল-বিকেল পানি ছিটিয়ে দিই। ফলে ছাই ওড়ে না। আমাদের চিমনিও বড়।’

গোপালগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘পুলহাট আর গোপালগঞ্জ আসতে হলে আপনাকে চোখের সুরক্ষা নিতে হবে, অধিক সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, যেকোনো সময় চোখের মধ্যে ছাই পড়লে ভোগান্তির শেষ থাকবে না। জানালেন, মাস পাঁচেক আগে চোখে ছাই পড়েছিল। প্রথমে গুরুত্ব দেননি। পরে চোখ ফুলে যায় এবং পানি ঝরতে থাকে। দুই দিন পরে চিকিৎসকের কাছে যান। তখন চিকিৎসক জানান, চোখের মণির কাছে ছাইয়ের ধারালো একটি কণা ঢুকে আছে।’

দিনাজপুরে বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ণয়ে কাজ করছেন হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদেরই একজন হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম বলেন, দিনাজপুরের বিভিন্ন জায়গায় ১০টি যন্ত্র (ডিভাইস) বসানো হয়েছে। বছরব্যাপী গবেষণাকাজ চলবে। চার মাস অতিক্রম হয়েছে। ডিভাইসের মাধ্যমে বাতাসে যে ধরনের পার্টিকেল বা বস্তুকণা উড়ে বেড়ায়, তার পরিমাপ নির্ধারণ করা হবে। দূষণের সহনীয় মাত্রা শূন্য থেকে ১৫০ স্কেল। কিন্তু ইতিমধ্যে গবেষণায় কিছু জায়গায় ৩০০-৩৫০ স্কেল পরিমাপ করা হয়েছে। তবে গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুরোপুরি কিছু বলা যাবে না।’

চালকলের ছাই ও ধোঁয়া কমিয়ে আনার বিষয়ে হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাত হোসেন সরকার বলেন, সাধারণত চালকলের চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে ছাই ও বিভিন্ন সলিড পার্টিকেল (বস্তুকণা) আশপাশে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। নির্গত ধোঁয়া সাইক্লোনিক সেপারেশন প্রক্রিয়ায় প্রবাহিত হয়ে চিমনিতে প্রবেশ করার কথা। কিন্তু মিলগুলোতে এই ব্যবস্থা না থাকা, অকার্যকর হওয়া কিংবা সনাতন প্রযুক্তির হওয়ায় চিমনি দিয়ে নির্গত ধোঁয়া পরিশোধন ছাড়াই ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই সাইক্লোনিক সিস্টেমটিতে একজন মিলমালিকের ক্যাপাসিটি ভেদে ১৫-২৫ লাখ টাকা খরচ পড়বে। এ ছাড়া প্রচলিত স্টিম বয়লার ব্যবহারের পরিবর্তে সাইক্লোনিক ফার্নেস দিয়ে ডায়ার পরিচালনা করলে তুসের পরিপূর্ণ দহন হয়। ফলে ধোঁয়া ও ছাইয়ের পরিমাণ কমে যাবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালকলমালিক বলেন, ‘পরিবেশ আইনের প্রায় সব শর্ত পূরণ করে মিল চালাই। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনের পৃথক আইন আছে। চালকলের ক্ষেত্রেও পরিবেশ আইনের বাইরে একটা আইন থাকা দরকার এবং একই সঙ্গে আইনের প্রয়োগ দরকার।’

এ বিষয়ে দিনাজপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রুনায়েত আমিন রেজা বলেন, জেলায় পরিবেশ আইন অনুযায়ী মিল পরিচালিত হচ্ছে ১৪ শতাংশ। অন্যগুলোর কোনো না কোনো ত্রুটি থেকেই গেছে। মিলের চিমনি, সাইক্লোনিক সিস্টেম, মিল থেকে নির্গত গরম পানি ও ছাই সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে ১০০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি মাসে ৩০ জন মিলমালিককে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে নোটিশ দেওয়া হবে। শেষ ৪০ দিনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কিংবা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।