ইলিশা গিলছে জনপদ 

সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। কয়েক মাসে ২৫০ একর ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে বিদ্যালয় ও মসজিদ।

ইলিশা নদীতে প্রবল স্রোতে ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুরে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। গত মঙ্গলবার ইউনিয়নের কন্দ্রকপুরে
ছবি: প্রথম আলো

ভোলার সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কন্দ্রকপুর গ্রামের কোড়ালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তাল ইলিশা নদীর মাত্র ৩৫-৪০ হাত দূরে। এই দূরত্ব কোনো ভয়ের ছিল না, যদি ভাঙন তীব্র না হতো। শঙ্কা আরও বাড়িয়েছে বিদ্যালয়ের পাশের মসজিদের বিশাল পুকুর। সম্প্রতি পুকুরের উত্তরপাড় ভেঙে নদী এসে বিদ্যালয়ের মসজিদ ভবন ছুঁই ছুঁই করছে।

ভাঙনের মুখে ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণের দাবিতে জানুয়ারি মাসেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু ভাঙন প্রতিরোধের কেউ কোনো চেষ্টাও করেনি। তাই  বিদ্যালয় ও মসজিদ ভবনটি এখন হুমকির মুখে পড়েছে। গত মঙ্গলবার সরেজমিন এ দৃশ্য দেখা যায়।

রাজাপুর ইউনিয়ন ২৫ বছর ধরে ভাঙছে। এ দীর্ঘ সময়ে কমপক্ষে ১০টি মৌজার কয়েক হাজার একর জমি-বাড়িঘর বিলীন হয়েছে।
রেজাউল হক, চেয়ারম্যান, রাজাপুর ইউপি, ভোলা

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়খাল থেকে মেহেন্দীগঞ্জের চর বাহাদুরপুর পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার ইলিশা নদীতে বর্ষাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে তীব্র ভাঙন চলছে। বর্ষা শুরু হওয়ার পর এই অংশের ২৫০ একর ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। নদী বাড়ির খুব কাছে চলে আসায় ৫০টি পরিবার তাদের ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। নদীভাঙনে হুমকির মুখে রয়েছে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২০টি মসজিদ-মাদ্রাসা ও প্রায় ৫ হাজার পরিবার। এসব পরিবারের ঘর ও প্রতিষ্ঠানে উচ্চ জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। প্রায়ই পানিবন্দী হয়ে পড়ায় তাঁরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।

নদীতীরে কংক্রিটের ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণের দাবিতে ইউনিয়নবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কয়েকবার ঢাকায় প্রকল্প নকশা তৈরি করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু এখনো ওই প্রকল্প পাস হয়নি। 

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের আলিমাবাদ ইউনিয়নের অংশ (ভোলাসংলগ্ন) চর বাহাদুরপুরের পূর্ব দিকে ভোলার রাজাপুর ইউনিয়নের চর মোহাম্মদ, কন্দ্রকপুর ও দক্ষিণ রাজাপুর, জোড়খালসহ প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইলিশা নদীর তীর। নদীর প্রবল স্রোত ও উজানের ঢলের আঘাতে তীর ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। ভাঙনে যেমন ফসলি জমি, বসতবাড়ি ভাঙছে, তেমনি উচ্চ জোয়ারে ওই সব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

মেহেন্দিগঞ্জের অংশ বাদ দিয়ে ভোলার সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় আড়াই কিলোমিটার, কন্দ্রকপুরের সাড়ে তিন কিলোমিটার এবং দক্ষিণ রাজাপুরের সোয়া এক কিলোমিটারসহ সোয়া সাত কিলোমিটার তীর অরক্ষিত রয়েছে। দুই বছর আগে রাজাপুরের জোড়খাল পর্যন্ত ব্লক ফেলে ভাঙন প্রতিরোধ করলেও তাঁর পশ্চিমে সাত কিলোমিটারে ভাঙন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

সরেজমিন আরও দেখা যায়, রাজাপুর ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে ইউনিয়নের ২, ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ড সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এখানে প্রায় পাঁচ পরিবারের বসত। তা ছাড়া বাঁধের বাইরের কয়েক হাজার একর জমিতে কয়েক শ কোটি টাকার ফসল উৎপাদিত হচ্ছে।

  নদীভাঙনকবলিত জোড়খাল এলাকার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যখন ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণ হয়, তখন পূর্ব দিকে আরও দুই চেইন (৩০০ হাত) ছিল। এখন সেই দুই চেইন ভেঙে আরও ১০০ হাত ভেঙে নদী ভেতরে তার ঘরের সামনে চলে এসেছে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময় তাঁর ঘরে পানি ওঠে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জোড়খাল থেকে চর মোহাম্মাদ আলী পর্যন্ত অনেক মানুষের ঘরের দরজায় নদী চলে এসেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারে মাটির বসতভিটা ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় মানুষের ঘর থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তাঘাট নেই। জোয়ারের সময় দেখে মনে হয়, নদীর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ঘর। জোয়ার উঠে মিঝি বাজার থেকে জোড়খাল সড়ক, ছায়েদ আলীর দোকান থেকে উত্তরে রামদাসপুর স্কুল সড়ক, রাজাপুর বানিয়ারচর থেকে জংশন মাদ্রাসা সড়ক, দারগারখাল বাজার থেকে আবদুল খালেক ডাক্তার বাড়ি, চরসিতারাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়কসহ ১৫টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে একাধিক কালভার্ট।

রাজাপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রুহুল আমিন মিজি জানান, তাঁর পরিবারের ১০ একর জমি মেঘনা ও ইলিশা নদীতে বিলীন হয়েছে। কয়েকবার বাড়ি সরিয়ে উত্তর রামদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গড়েছেন। এখন সেটি ভাঙনের মুখে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জোয়ারে তাঁর ঘর প্লাবিত হচ্ছে। এ সময় রান্না করতে, উঠতে-বসতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাসুদরানা বলেন, জোড়খাল এলাকায় যে দুই কিলোমিটার এলাকায় তীর সংরক্ষণ ব্লকবাঁধ দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে ভাঙনে বিলীন হতে হতে উত্তরে থাকা নদী দক্ষিণে গ্রামের দিকে ঢুকে পড়েছে। যদি নদী বাঁক নিয়ে দক্ষিণ থেকে পূর্ব দিকে চলে যায়, তাহলে সরকারের কয়েক শ কোটি টাকার তীর সংরক্ষণ ব্লকবাঁধ বিলীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই পূর্বাংশের ব্লকবাঁধ টেকসই করতে পশ্চিমের তীর সংরক্ষণ করা উচিত।

এ বিষয়ে রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রেজাউল হক মিঠু চৌধুরী বলেন, ‘রাজাপুর ইউনিয়ন ২৫ বছর ধরে ভাঙছে। এ দীর্ঘ সময়ে কমপক্ষে ১০টি মৌজার কয়েক হাজার একর জমি-বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। বর্তমানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ১০টি বিদ্যালয়, বাজার, রাস্তাঘাটসহ পাঁচ হাজার পরিবার হুমকির মুখে আছে।’

পাউবোর ভোলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন, জরুরিভিত্তিতে ভাঙনকবলিত এলাকায়  জিওটেক্সটাইল বস্তা ফেলা হবে। সর্বশেষ সদর উপজেলার রাজাপুর, ইলিশা, কাচিয়া, ধনিয়া ও শিবপুর ইউনিয়ন মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার মেঘনার তীর সংরক্ষণের একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের জন্য জমা আছে।