তীব্র শীতে কষ্টে আছেন তাঁরা

গতকাল সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গা জেলায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঠান্ডার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে কষ্ট হচ্ছে নৈশপ্রহরীদের।

শীত-বৃষ্টিতে রাত জেগে দায়িত্ব পালন করেন নৈশপ্রহরীরা। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে চুয়াডাঙ্গা শহরের পুরাতন গলির বাজারেছবি: প্রথম আলো

গভীর রাত। সুনসান নীরবতা। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে চারদিক। ১০ গজ দূরের কিছু ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। মাথাভাঙ্গা নদী থেকে ঠান্ডা বাতাস হু হু করে ঢুকছে শহরে। এমন নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই নির্ঘুম দায়িত্ব পালন করছেন নৈশপ্রহরী কাজী অহিদুল ইসলাম (৬৫)। সহকর্মী নৈশপ্রহরীদের সজাগ রাখতে মাঝেমধ্যেই হাঁকডাক দিয়ে চলেছেন, বাজাচ্ছেন বাঁশি। 

কাজী অহিদুলের মতো শতাধিক নৈশপ্রহরী ঝড়-বৃষ্টি-শীত উপেক্ষা করে চুয়াডাঙ্গা শহরকে নিরাপদ রাখতে রাতের পর রাত জেগে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু কনকনে ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছেন তাঁরা। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে দায়িত্ব পালন করলেও অহিদুলদের জন্য শীতবস্ত্র বা কম্বল নিয়ে আসেননি কেউ। অহিদুলের ভাষ্য, ‘কেউ শীতবস্ত্র বা কম্বল দিক বা না দিক, যত কষ্টই হোক, অন্যের আমানত রক্ষার যে দায়িত্ব নিয়েছি, তা পালন করতেই হবে।’ 

চার দফায় ছয় দিন মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, একদিন মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের পর গতকাল চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে আবারও মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলেছে। পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আর্দ্রতা ৯৪ শতাংশ। সেই সঙ্গে রয়েছে ঘন কুয়াশার সঙ্গে উত্তর থেকে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাসে জীবন অনেকটাই বিপর্যস্ত।

শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে চুয়াডাঙ্গা শহরের ফেরিঘাট রোডে কথা হয় নৈশপ্রহরী কাজী অহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি মেহেরপুর সদর উপজেলার বারাদী  ইউনিয়নের বর্শিবাড়িয়া গ্রামে। প্রায় ১৪ বছর ধরে চুয়াডাঙ্গার বাজারে এই নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন। চলমান শীত ও শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে তিনি বলেন, ‘তিন বছর আগে এমন শীত পড়েছিল। তবে এবার শীতটা একটু বেশি অনুভূত হচ্ছে।’

চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানের নৈশপ্রহরীরা জানান, বছরের ৩৬৫ দিন সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোনো প্রকার ছুটি নেই। এমনকি ঈদের দিনও সময় মেনে কর্মস্থলে আসতে-যেতে হয়।

অহিদুলের অধীনে তিনজন নৈশপ্রহরী আছেন। অহিদুল তাঁদের সুপারভাইজার। ওই তিনজন হলেন আলাল উদ্দিন (৫৫), অশোক কুমার (৬২) ও মসলেম উদ্দিন (৮০)। মসলেম জানালেন, জরুরি প্রয়োজনে আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে দ্রুত ফিরতে হয়। 

বাগানপাড়ার আলাল উদ্দিন বলেন, শীতকালেও কষ্ট, বর্ষাকালেও কষ্ট। ১৭ জানুয়ারি ভোরে সবাই বৃষ্টিতে এক ঘণ্টা ধরে কাকের মতো ভিজেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাতে শতকোটি টাকার সম্পদ পাহারা দিই। অথচ যে পরিমাণ কষ্ট করে থাকি, সে অনুযায়ী মাসের আয়রোজগার হয় না। সংসারের খরচ জোগাড় করতি দিনির বেলা সবজি বিক্রি করি।’ পূজাতলাপাড়ার অশোক কুমার দের ভাষ্য, ‘প্রায়ই শুনি, সরকারি-বেসরকারিভাবে শীতবস্ত্র-কম্বল দিয়া হয়। আমাগের মতো গরিপির দিকি কেউ তাকাই না।’

সদর উপজেলার দৌলতদিয়াড় গ্রামের রনবকস ১৭ বছর ধরে নৈশপ্রহরীর কাজ করেন। এর আগে রিকশা চালাতেন। তাঁর ৫ সদস্যের পরিবার। রনবকস বলেন, ‘প্যাটের দায় বড় দায়। যেদিন বৃষ্টি হয়, বেশি শীত পড়ে, মনডা ভালো লাগে না। আমরা তো পেটের দায়ে কাজ করি।’

মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা হারেজ আলী (৬০) প্রায় ৩০ বছর ধরে নৈশপ্রহরীর কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার আয়রোজগারে চার সদস্যের সংসার চলে। ৬ হাজার থেকে এক মাস আগে ৮ হাজার বেতন হয়েছে। এত কোম ট্যাকায় সংসার আর চলে না।’