এক উপজেলায় পাঁচ ‘সাগরে’ মুগ্ধ দর্শনার্থীরা

দিনাজপুরে আসা পর্যটকদের সবচেয়ে প্রিয় স্থান রামসাগর। সাগরের চারপাশে সামাজিক বনায়ন। রয়েছে চিড়িয়াখানা। রামসাগরের স্বচ্ছ নীল জলে মুগ্ধ হন পর্যটকেরাছবি: রাজিউল ইসলাম

শহর ঘেঁষে পাঁচটি ‘সাগর’। বছরের প্রায় সব সময় এসব ‘সাগর’পাড়ে কমবেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে চলেছে পাঁচ ‘সাগরের’ স্বচ্ছ নীল জল। ‘সাগরের’ কথা মনে ভাসতেই সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শো শো আওয়াজ কানে অনুভূত হয়। কিন্তু এই পাঁচ ‘সাগরের’ পাড়ে সেই আওয়াজ নেই। উল্টো আছে নৈঃশব্দ্য। সঙ্গে বাহারি পাখির কুজন।

এই পাঁচ ‘সাগরের’ দেখা মিলবে উত্তরের প্রাচীন জনপদ দিনাজপুর সদর উপজেলায়। এগুলোর হলো শুকসাগর, মাতাসাগর, রামসাগর, আনন্দসাগর ও জুলুমসাগর।কৃষিনির্ভর দিনাজপুর রাজা-মহারাজাদের ইতিহাসে যেমন সমৃদ্ধ; তেমনই মন্দির, মসজিদ, বৌদ্ধবিহার, রাজবাটী আর কৃত্রিম সাগরগুলো কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

সাগরগুলো নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে নানা জনশ্রুতি আছে। কেউ বলেন, প্রচণ্ড খরা থেকে বাঁচতে প্রজাদের কথা চিন্তা করে তৎকালীন রাজা সাগরগুলো খনন করেছিলেন। কারও মতে, অলৌকিকভাবে সাগর তৈরি হয়েছে। আবার কারও ভাষ্য, রাজ্য চালাতে গিয়ে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব সাগর খনন করা হয়েছে। এসব সাগরের পেছনের গল্পই তুলে ধরা হলো।

শুকসাগরে গোসলে নেমেছেন কয়েকজন। সম্প্রতি দিনাজপুর শহরের পাশে রাজবাটী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

শুকসাগর

১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মেজর শেরউইলের জরিপসংক্রান্ত বিবরণ থেকে দিনাজপুরে ১৫ হাজার প্রাচীন দিঘি ও পুকুরের কথা জানা যায়। এসব রাজ-জমিদারি এস্টেটের প্রাচীন কীর্তি। এফ ডব্লিউ স্ট্রং রচিত ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার দিনাজপুর (১৯১২)’–এর তথ্যমতে, রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন শুকদেব রায়। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, দেবদ্বিজ ভক্ত, সৎকর্মশীল ও উদার মানসিকতার। ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে প্রজাদের জন্য এবং স্মৃতিস্বরূপ একটি দিঘি খনন করা হয়েছিল। পরে সেটি নামকরণ করা হয় শুকসাগর।

শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে রাজবাটী এলাকায় শুকসাগরের অবস্থান। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সাগরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭০ মিটার এবং প্রস্থ ১৯৫ মিটার। জলভাগের আয়তন প্রায় ২২ দশমিক ৬৩ একর, আর পাড়ের আয়তন ২২ দশমিক ৯৯ একর। সাগরের উত্তর প্রান্তে রাজা ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে একটি শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে সেটির অস্তিত্ব নেই। সাগরের তিন পাশে আছে নানা গাছগাছালি। সম্প্রতি সাগরপাড়ে ইকোপার্ক তৈরি করা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন রাইড, বসার ছাউনি, বেঞ্চ, টি স্টল ও রেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়েছে। সাগরের স্বচ্ছ পানিতে ভেসে থাকে নানা প্রজাতির মাছ। অতিথি পাখিদের সঙ্গে বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যাও। সাগরপাড়ে বনভোজন কিংবা চড়ুইভাতির আয়োজনও করেন ভ্রমণপিপাসুরা।

দিনাজপুর শহরের পাশে ঐতিহ্যবাহী মাতাসাগর। চারপাশে উঁচু পাহাড়ের মতো ঢিবিতে বসে সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করেন পর্যটক ও দর্শনার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

মাতাসাগর

দূর থেকে দেখলে পাহাড়ের মতো লাগে। কাছে এলে পরিষ্কার বোঝা যায়, মাতাসাগরে বাতাসে দুলছে টলটলে জল। সকালে কিংবা বিকেলে এই সাগরে সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন দর্শনার্থীরা। ধবধবে সাদা বক মাছ ধরে উড়ে যাচ্ছে। দল বেঁধে আকাশে ভেসে বেড়ায় পরিযায়ী পাখি। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে মাতাসাগর অবস্থিত। এটির দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে গড়ে ৫০০ মিটার, আর প্রস্থ ১৭০ মিটার। সাগরের জলভাগের আয়তন ২১ দশমিক ১৪ একর। পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। আয়তন ২৪ দশমিক ৪৬ একর।

স্থানীয় লেখক মেহরাব আলীর ‘দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র-৪’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, দিনাজপুরের প্রথম রাজা শুকদেবের ছিল দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর দুই সন্তান রামদেব ও জয়দেব। দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র পুত্রের নাম ছিল প্রাণনাথ। শুকদেবের মৃত্যুর পর নিয়মানুযায়ী সিংহাসনে বসেন জ্যেষ্ঠ পুত্র রামদেব। বছরখানেকের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হলে রাজ্য চালনার ভার পড়ে জয়দেবের ওপরে। ১৬৮২ সালে জয়দেবেরও মৃত্যু হয়। ১৬৭৭-৮২, মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে ২ ভাইয়ের মৃত্যু হলে সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র পুত্র প্রাণনাথ। ৪০ বছর রাজত্ব করে রাজবংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতিও হন তিনি।
এদিকে পরপর দুই সন্তানের মৃত্যুতে মর্মাহত ও শোকাতুর হয়ে পড়েন প্রাণনাথের মা। মায়ের কষ্ট দূর করতে ব্রত পালন ও নানা সামাজিক কাজ করেন প্রাণনাথ। সে সময় এ অঞ্চলে সুপেয় পানির কষ্ট ছিল মানুষের। অবশেষে জীবের জন্য জলদানের উদ্দেশ্যে রাজবাটীর দক্ষিণ প্রান্তে একটি দিঘি খনন করেন। মাকে দিয়ে সেই দিঘির উদ্বোধন করেন। পরে সেটির নাম হয় মাতাসাগর। সাগরের পূর্ব পাড়ে স্থাপন করা হয় মা মনসার ঘট।

তিন শিশু দাঁড়িয়ে আছে রামসাগরের পাড়ে
ছবি: প্রথম আলো

রামসাগর

দিনাজপুরে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো মধ্যে রামসাগর অন্যতম। শহর থেকে প্রায় আটন কিলোমিটার দক্ষিণে তাজপুর এলাকায় এ সাগরের অবস্থান। দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ মিটার, আর প্রস্থ গড়ে ২৩৬ মিটার। জলভাগের আয়তন প্রায় ৬০ একর, গভীরতা ৩০ ফুট, পাড়ভূমির পরিমাণ ৭০ দশমিক ৭৬ একর। নবাব আলীবর্দী খানের সময়ে ১৭৫০-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সাগরটি খনন করেছিলেন রামনাথ। সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৫২ প্রজাতির গাছ। গড়ে উঠেছে মিনি চিড়িয়াখানা। তাতে দেখা মিলবে হরিণের দল। প্রতিবছর লক্ষাধিক পর্যটক রামসাগরের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে আসেন। ১৯৬০ সালে এটি বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আনা হয়। ১৯৯৫ সালে রামসাগরকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র এবং ২০০১ সালে রামসাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠা বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৭২২-৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিনাজপুরের রাজা ছিলেন রামনাথ। তিনি ছিলেন রাজা প্রাণনাথের পালক পুত্র। ১৭৫০-৫৫ খ্রিষ্টাব্দ, ৫ বছর ধরে রামনাথ ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রজাদের জন্য দিঘি খনন করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, গভীর করে খননের পরও জলের দেখা পাওয়া যায়নি। একদিন রাজা দৈববাণী পেয়ে দিঘির মাঝখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। পরে একদিন ভোরে মন্দিরে প্রবেশ করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তলদেশ থেকে জল উঠতে শুরু করে। চোখের নিমেষেই টইটম্বুর হয় দিঘি। রামনাথ তলিয়ে যান দিঘির অতলে। সেই থেকে দিঘির নাম হলো রামসাগর। প্রতিবছর মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে এখানে বসে বারুণি মেলা। দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া রাজপুত্র রামনাথের স্মরণে প্রতিবছর এই দিনে স্নান করতে এখানে আসেন হিন্দুধর্মাবলম্বীরা।

দিনাজপুর শহরের পাশেই নেমতাড়া এলাকার আনন্দসাগর। সম্প্রতি দখল–দূষণে সাগরটি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে
ছবি: প্রথম আলো

আনন্দসাগর

রাজা রামনাথের চার পুত্রের একজন বৈদ্যনাথ রায়। তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবীর আরেক নাম ছিল আনন্দময়ী। বংশপরম্পরায় ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনিও বর্তমান শশরা ইউনিয়নের নেমতাড়া গ্রামে প্রায় সাত একর জায়গাজুড়ে একটি দিঘি খনন করেন। রানি আনন্দময়ী এই দিঘি উদ্বোধন করেছিলেন বলে এর নামকরণ হয়েছে আনন্দসাগর। শুকসাগর ও আনন্দসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল রামদাড়া নামে একটি সরু নালা। জনশ্রুতি আছে, রাজা প্রাণনাথের আমলেই আনন্দসাগর খনন করা হয়েছিল।

রাজা প্রাণনাথ রানিকে নিয়ে সোনার নৌকায় রাজবাটী থেকে আনন্দসাগরে নৌবিহারে যেতেন, তাই এর নাম হয়েছে আনন্দসাগর। এই সাগরপাড়ে একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এখনো আছে। প্রতিবছর সেখানে এক দিনের জন্য মেলাও বসে।

দিনাজপুর শহরসংলগ্ন গোর-এ-শহীদ মাঠের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জুলুমসাগর
ছবি: প্রথম আলো

জুলুমসাগর

৮৪৩ শতাংশ আয়তনের জুলুমসাগরটি দিনাজপুর শহরের মধ্যভাগের গোর-এ–শহীদ বড় ময়দানের পশ্চিমে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশের উন্নতি করার জন্য জেলখানার কয়েদিদের দিয়ে জোর করে একটি দিঘি খনন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এর নামকরণ হয়েছে জুলুমসাগর। দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে তৎকালীন রাজাদের নির্মিত জুলুমসাগর প্রাসাদ ছিল। ইংরেজ শাসন আমলের প্রথম দিকে দিঘিপাড়াটি সাহেবপাড়া হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে জুলুমসাগরকে কেন্দ্র করে বিজিবির কৃষ্ণকলি নামের একটি রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। এখানে পর্যটকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে এখানে দর্শনার্থীদের আড্ডা জমে।

এ পাঁচ সাগর বাদেও দিনাজপুর শহরে কালীসাগর, কৃষ্ণসাগর ও পদ্মপুকুর আছে, যা দেখতে আসেন বিভিন্ন এলাকার হাজারো মানুষ। স্থানীয় মানুষের ভাষ্য, পরিকল্পিতভাবে সাগরগুলোর সংস্কারকাজ করাসহ পর্যটক আকর্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এতে জেলায় পর্যটনশিল্পের যেমন বিকাশ ঘটবে, তেমনই জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।