জন্মের পর থেকে ২ হাত নেই, পা দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম

পা দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম মিয়া। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরিষাবাড়ীর হরখালী মুজিবুর রহমান আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় পরীক্ষাকেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

জন্মের পর থেকে দুই হাত নেই সিয়াম মিয়ার (১৬)। ছোটবেলা থেকে পা দিয়ে লিখে নিজের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়েছে। অভাবের সংসারে চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতে একবার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবু দমে যায়নি সিয়াম। অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দুই হাত ছাড়াই পা দিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে সিয়াম।

সিয়াম জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের দিনমজুর জিন্নাহ মিয়ার ছেলে। সরিষাবাড়ীর চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মানবিক শাখা থেকে এবার সে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সিয়াম সবার ছোট। বড় বোন ও ভাই স্নাতক পাস করেছেন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই চাকরিপ্রত্যাশী।

শিক্ষক ও স্বজনেরা জানান, ২০০৮ সালে জোসনা বেগম-জিন্নাহ মিয়া দম্পতির ঘর আলো করে সিয়ামের জন্ম হয়। জন্মের পর থেকেই তার দুই হাত ছিল না। ২০১৪ সালে তাকে বাড়ির পাশে উদনাপাড়া ব্র্যাক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন মা-বাবা। চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার পর সিয়ামের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের সংসারে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছিলেন না দিনমজুর জিন্নাহ মিয়া। এক বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকার পর ব্র্যাক স্কুলের এক শিক্ষকের প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালে সিয়াম প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেয়। এরপর চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় সিয়াম।

সিয়ামের বাবা জিন্নাহ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিনটি বাচ্চাকে এ পর্যন্ত এনেছি। ভিটামাটি ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। ছেলে আমার প্রতিবন্ধী নয়, ভবিষ্যৎ সোনার টুকরা।’

অন্য পরীক্ষার্থীর সঙ্গে একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছে সিয়াম। বৃহস্পতিবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

মা জোসনা বেগম বলেন, ‘অভাবের সংসারে ছেলের পড়ালেহা এক বছর বন্ধ ছিল। স্কুলের জাকিয়া ম্যাডাম লেহাপড়া ও খাওনের খরচ দিব বইলা ছেলেরে আবার স্কুলে ভর্তি করায়। ছেলেরে ঠিকমতো খাবার দিতে পারি নাই। তবু ছেলে রাগ না কইরা স্কুলে গেছে।’

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সিয়ামের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সরিষাবাড়ীর হরখালী মুজিবুর রহমান আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় পরীক্ষাকেন্দ্রে সে আজ বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা দেয়। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় অন্য পরীক্ষার্থীর চেয়ে ৩০ মিনিট বেশি সময় পেয়েছে সে। তবু নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট আগেই সে পরীক্ষা শেষ করে।

দুপুর সাড়ে ১২টার সময় ওই পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, অন্য পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম। অন্যরা বেঞ্চে বসে টেবিলের ওপর খাতা রেখে পরীক্ষা দিলেও সিয়াম বসার বেঞ্চের ওপর খাতা রেখে পা দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। একটু পরপর জিরিয়ে আবার পরীক্ষা দিচ্ছিল সে।

সিয়াম প্রথম আলোকে বলে, ‘পা দিয়ে লিখতে আমার একটু কষ্ট হয়। কিছুক্ষণ পরপর পায়ে ব্যথা করে। একটু বসে থেকে ফের লিখা শুরু করি। সাড়ে তিন ঘণ্টার আগেই সব প্রশ্নের উত্তর লিখা শেষ করেছি। আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই।’

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় অন্য পরীক্ষার্থীর চেয়ে ৩০ মিনিট বেশি সময় পেয়েছে সিয়াম। তবু নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট আগেই সে পরীক্ষা শেষ করে
ছবি: প্রথম আলো

কক্ষ পরিদর্শক হারুণ অর রশিদ ও সুমন মিয়া বলেন, প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ৩০ মিনিট বেশি সময় দেওয়া হয়। সিয়াম ১৫ মিনিট আগেই পরীক্ষা শেষ করেছে।

পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সিয়াম অন্য সবার সঙ্গে বসে তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়েছে। বিশেষ সময়ের ১৫ মিনিট আগেই পরীক্ষা শেষ করেছে।

চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও সিয়ামের ইচ্ছাশক্তি প্রবল। একদিন দেশের হয়ে গৌরব বয়ে আনবে সে। সিয়াম পরীক্ষায় ভালো ফল করবে বলে তিনি আশাবাদী।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থী সিয়ামকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। সিয়াম কষ্ট করে পা দিয়ে লিখে এ পর্যন্ত এসেছে। সিয়াম ও তার পরিবারকে সহযোগিতা করা সবার দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেন।