ঢাকায় বেড়াতে এসে গুলিতে মারা যান সাগর, এইচএসসি পাসের খবরে ভেঙে পড়েছেন মা-বাবা

সাগরের এইচএসসির ফলাফল নিয়ে জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা শাহিদা বেগম। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর বাবা সিরাজুল গাজী। গতকাল বিকেলে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ডাকুয়া ইউনিয়নের পারডাকুয়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গুলিতে নিহত সাগর গাজী (১৯) চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ফলাফলে তিনি জিপিএ–৩.৯২ অর্জন করেছেন। এ খবর জেনে আরও ভেঙে পড়েছেন তাঁর মা শাহিদা বেগম ও বাবা সিরাজুল গাজী। তাঁদের দাবি, বেঁচে থাকলে এ খবরে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন সাগর।

সাগরের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ডাকুয়া ইউনিয়নের পারডাকুয়া গ্রামে। বাবা সিরাজুল গাজী পেশায় নির্মাণশ্রমিক। তিন ভাইয়ের মধ্যে সাগর ছিলেন সবার ছোট। উপজেলার উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন।

আরও পড়ুন

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে চলতি বছরের এইচএসসির কয়েকটি পরীক্ষা স্থগিত হয়েছিল। ওই সময় ঢাকায় বড় ভাই সুমন গাজীর বাসায় বেড়াতে যান সাগর। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিজয় মিছিল দেখতে বেলা দুইটার দিকে রাজধানীর উত্তরার রাস্তায় বেরিয়েছিলেন সাগর। ওই সময় হঠাৎ একটি গুলি এসে তাঁর মাথার পেছনে লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই দিন রাতেই মরদেহ গ্রামের বাড়িতে এনে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সাগর গাজী
ছবি: সংগৃহীত

গতকাল বিকেলে সাগরের বাড়িতে ঢুকতেই পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর কবরের দেখা মেলে। পাশেই বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল সগৌরবে। এই প্রতিবেদক দরজায় কড়া নাড়লে বাইরে বেরিয়ে আসেন সাগরের মা শাহিদা বেগম। ছেলের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে জানতে চাইলে মুহূর্তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। ধরে আসা গলায় তিনি বলেন, ‘বুকের আদরের ধন (সাগর) আইজ বাঁইচ্যা থাকলে কত খুশি হইতো! কত আনন্দ করত! আর এহন শুধু কান্না ছাড়া আর কিছুই নাই।’

আরও পড়ুন

সাগরদের বাড়ির পাশেই থাকেন সহপাঠী অন্তু মোল্লা ও পরাগ গাজী। জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, সাগর খুব হাসিখুশি ছিলেন। মা, বাবা ও ভাইয়েরা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। কলেজে সবার সঙ্গেই মিলেমিশে চলতেন। সাগরের মৃত্যুতে একজন ভালো বন্ধু হারাতে হয়েছে বলে জানান তাঁরা।

সাগরের মেজ ভাই শাওন গাজী টঙ্গী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। ঘটনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর বড় ভাই সুমন গাজী ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কলেজ বন্ধ থাকায় তাঁর বাসাতেই বেড়াতে গিয়েছিলেন সাগর। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি।

বুকের আদরের ধন (সাগর) আইজ বাঁইচ্যা থাকলে কত খুশি হইতো! কত আনন্দ করত! আর এহন শুধু কান্না ছাড়া আর কিছুই নাই।
সাগরের মা শাহিদা বেগম

সাগরের পাসের খবর কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তাঁর বাবা সিরাজুল গাজী। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেদের লেখাপড়া করিয়েছি। সাগর সবার কাছে খুব আদরের ছিল। পরীক্ষায় পাস করেছে সে। এতে আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু পাসের খবরে আরও কষ্ট বাড়িয়ে দিল। নিজেদের সংসারের কষ্টের কথা বললেই সাগর বলত, সে লেখাপড়া করে চাকরি করে বুড়ো মা–বাবাকে দেখবে। আমাদের বুকের মধ্যে আগলে রাখবে...।’ কথাগুলো শেষ না করেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সাগরের বাবা।

একটু থেমে সিরাজুল গাজী আবার বলতে শুরু করলেন। এবার তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের বাসায় বেড়াতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল সাগর। ওর কী অপরাধ ছিল? যারা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।’

সাগরের ফলাফলের খবরে মন খারাপ হয়েছে গলাচিপার উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহফুজুর রহমানেরও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র হিসেবে সাগর ভালো ছিলেন। তাঁর আচার-আচরণও ছিল সুন্দর। এভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি খুবই কষ্টের।