ভেড়া পেলে ভাগ্যবদল রংপুরের তিন শতাধিক নারীর

ভেড়া পালন করে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার প্রামাণিকপাড়া গ্রামের বেবি বেগমের ভাগ্য বদল হয়েছেছবি: প্রথম আলো

অভাবের সংসারে দুবেলার খাবার জুটত না। প্রতিদিনই ঝগড়া লেগে থাকত। প্রায় দিনই থাকতে হতো উপোস। এ অবস্থায় প্রতিবেশী এসমোতারা বেগমের কাছ থেকে এক হাজার টাকায় একটি ভেড়া কিনে পালন শুরু করেন বেবি বেগম। এটা ২০১৩ সালের কথা। গত ১০ বছরে ভেড়ার পালন করে নিজের সংসারে অভাব দূর করেছেন। দেড় শতাধিক ভেড়া বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন, আয় করেছেন প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।

শুধু নিজের ভাগ্য বদল করে থেমে থাকেননি, প্রতিবেশী ও আশপাশের গ্রামের অভাবী নারীদেরও পথ দেখিয়েছেন বেবি। সংগ্রামী এই নারী খামারির বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের প্রামাণিকপাড়া গ্রামে। এই গ্রামসহ আশপাশের পাঁচটি গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ৩০০ নারী এখন ভেড়া পালন করছেন। বেবির দেখানো পথ অনুসরণ করে তাঁদের প্রত্যেকে এখন বাড়িতে ভেড়ার খামার গড়ে তুলেছেন।

তারাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে প্রামাণিকপাড়া গ্রাম। বেবি বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ভেড়াকে পাতা খাওয়াচ্ছেন। সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বেবি বেগম বলেন, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে দেখেন অভাব আর অভাব। থাকার আশ্রয়টুকুও জরাজীর্ণ। স্বামী জুয়ায় আসক্ত হলে অভাব আরও প্রকট হয়। প্রায়ই অনাহারে থাকতে হতো। অভাবের কারণে প্রায় অন্যের খেতখামারে, বাড়িতে কাজে যেতেন বেবি বেগম। সেই কাজে উপার্জিত টাকা জমিয়ে ১ হাজার টাকা দিয়ে ২০১৩ সালের মার্চে প্রতিবেশী এসমোতারার কাছ থেকে একটি ভেড়া কিনে পালন শুরু করেন। বছর না ঘুরতেই সেই ভেড়া দুই দফায় পাঁচটি বাচ্চা দেয়। তা বিক্রি করে আয় হয় সাত হাজার টাকা। এভাবে একসময় ভেড়ার সংখ্যা বাড়ে, বেবির অভাবের সংসারে ফেরে সচ্ছলতা।

গত বছর ২১টি ভেড়া বিক্রি করে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা আয় করেন বেবি। বর্তমানে তাঁর খামারে ২৫টি ভেড়া আছে। লাভের টাকায় টিনের ঘর করেছেন, স্বামীকে কিনে দিয়েছেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা (ইজিবাইক)। এক একর জমি বন্ধক নিয়ে করছেন চাষাবাদ। বেবি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শান্তিতে ঘুমাবার জায়গা আছলো না। একসময় খুব কষ্টে খায়া না খায়া দিন গেইছে। এখন দুইবেলা খায়াপরি ভালোভাবে চলবার পারুছি। ভেড়া পুষি মোর সংসারোত ভালোয় উন্নতি হইছে।’

বেবি বেগমের ভাগ্যের পরিবর্তন দেখে প্রতিবেশী নারীরাও ভেড়া পালনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বেবি তাঁদের ভেড়া পালনের পরামর্শও দেন। ধীরে ধীরে ইকরচালী ইউনিয়নের প্রামাণিকপাড়া, ছুট মেনানগর, জুম্মাপাড়া, লক্ষ্মীপুর মণ্ডলপাড়া, দোহাজারীর প্রায় ৩০০ নারী ভেড়া পালনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।

ছুট মেনানগর গ্রামের খয়রন বেগম বলেন, বেবি বেগমের কাছ থেকে দুটি ভেড়া কিনে পালন শুরু করেন। তাঁর পরামর্শ নিয়ে তিনি দুই বছর ধরে ভেড়া পালন করছেন। বিক্রির পরও তাঁর খামারে এখন আটটি ভেড়া আছে।

জুম্মাপাড়া গ্রামের গৃহবধূ নুর বানুর এখন ১২টি ভেড়া, ২টি ছাগল ও হাঁস-মুরগি আছে। নুর বানু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগোত সংসারোত খুব অভাব আছলো। আল্লাহ দিলে ভেড়া নাগাছু থাকি কোনো অভাব নাই। ভেড়া বেচা টাকা দিয়া আবাদি জমি নিছু, তাক আবাদ করি ভাত খাওছু। স্বামীও ব্যবসা করোছে। সউগ মিলি ভাল আছি।’

নুর বানু ছাড়াও ওই গ্রামে ভেড়া পালন করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন সায়না বেগম, সেতারা খাতুন, গোলাপী বেগম ও অলিমা বেগম। অলিমা বেগম বলেন, ‘আগোত হামার এলাকাত ভেড়া আছলো না। অ্যালা ঘরে ঘরে ভেড়া। একটা ভেড়া তিনটা বাচ্চা পর্যন্ত দেয়। ছয় মাস পরপর বাচ্চা হয়। ভেড়া পালন করি হামরা ভালোয় লাভবান হওছি।’

ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জিয়াউর রহমান বলেন, প্রামাণিকপাড়া গ্রামের বেবি বেগমের দেখাদেখি আশপাশের নারীরাও ভেড়া পালন শুরু করেছেন। গৃহস্থালি কাজ শেষে অবসর সময়ে অলস বসে না থেকে তাঁরা ভেড়া পালন করে সংসারে আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেছেন। এ কারণে এলাকায় এখন আর ঝগড়াবিবাদ তেমন নেই বললেই চলে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলুল করিম বলেন, উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে সবচেয়ে বেশি ভেড়া পালন করা হচ্ছে। বেবি বেগম একজন সফল ভেড়ার খামারি। তাঁর মতো উদ্যমী নারীকে দেখে অনেকেই উৎসাহী হয়ে ভেড়া পালন করছেন। প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে তাঁরা ভেড়া পালনকারীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।