ঋণে জর্জরিত হয়ে নয় বছর আগে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় যান চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার দক্ষিণ ইসলামপুর গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আশাদুল ইসলাম (৪২)। ঢাকায় গিয়ে শুরু করেন রিকশা চালানো। বসবাস করেন বস্তিতে। শুরুতে খেয়ে না–খেয়ে কেটেছে দিন। এরই মধ্যে বড় ছেলে ব্যাটারিচালিত রিকশাভ্যান চালানো শুরু করেন। আর ছোট ছেলে নেন কাঠমিস্ত্রির কাজ। ধীরে ধীরে দিন বদলাতে শুরু করে।
তিনজনের আয়ে খেয়ে-পরে ঋণের ১২ লাখের ১১ লাখ টাকাই পরিশোধ করেন। আশাদুল ইসলাম স্বপ্ন দেখেন, ঋণের টাকা পুরো শোধ করার পর গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর তুলবেন। ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে নতুন বউ নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ছোট ছেলে মো. তারিক হোসেন (১৮) গুলিবিদ্ধ হন। চার দিনের মাথায় তিনি মারা যান। ১০ আগস্ট ছেলের লাশ এনে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করেন।
ছেলে হারানোর শোক, ক্ষোভ ও অভিমানে আশাদুল ইসলাম আর ঢাকায় ফেরেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশাদুল বলেন, ‘যে ঢাকা হামার ছ্যালাকে কাইড়্যা লিল, সে ঢাকাত আর হামারা যাব না। যেখানে মায়ামমতা নাই, আপনজন নাই, সেইখানে যায়্যা আর কী হইবে?’ গত রোববার দুপুরে ইসলামপুর গ্রামে ছেলের কবর জিয়ারতের পর এমন আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।
আশাদুল ইসলাম জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ঢাকায় আনন্দমিছিলে যোগ দিয়ে শেরেবাংলা নগর থানার সামনে মোড়ের কাছে গুলিবিদ্ধ হন তারিক। তাঁর পেটে চারটি ও হাতে একটি গুলি লাগে। তাঁকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৯ আগস্ট বিকেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর ছেলে মারা যান। পালিয়ে যেতে থাকা একদল পুলিশের ছোড়া গুলি লাগে তারিকসহ পাঁচজনের। এর মধ্যে তারিকসহ চারজন মারা যান। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মৃত্যুসনদে শাটগানের গুলিতে তারিকের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা ছেড়ে আসার পর এলাকাতেই রিকশা চালাচ্ছেন আশাদুল ইসলাম। আর রিকশাভ্যান চালাচ্ছেন বড় ছেলে মো. আসমাউল (২১)। পরিবার ও স্বজন সূত্রে জানা যায়, আশাদুল ইসলাম পাওনাদারদের ভয়েই ঢাকায় গিয়েছিলেন ভাগ্যবদলের আশায়। তখন তিন সন্তানই ছোট। ঢাকার আগারগাঁও বস্তির টিনের ছোট একটি ছাপরায় থাকতেন তাঁরা। রিকশা চালিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো ভাতের জোগান দিতেই হিমশিম খেতে হতো। ছোট দুই ছেলে তখন পথে পথে টোকাইয়ের মতো ঘুরে কাগজ ও লাকড়ি কুড়িয়ে আনত। সেসব পুড়িয়েই পরিবারের রান্না হতো।
দুই ভাই মিল্যা কত কষ্ট করি বড় হোইনু, এক সাথেই ছিনু। এ্যাখুন ভাই হারিয়্যা আর ঢাকা যাইতে মন চাহে না। ওখানে কেহু কাহুরি লয়। সুখে-দুঃখে দুটা মনের কথা কার সোথে কোহবো?
একটু বড় হলেই মো. আসমাউল রিকশাভ্যান চালাতে শুরু করেন। আর তারিক আসবাবপত্র তৈরির কারখানায় কাঠমিস্ত্রির কাজ নেন। দক্ষ কাঠমিস্ত্রি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বেতন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৪ হাজার টাকা। সে হিসেবে নয় দিনের বেতন পেয়েছিলেন। আসমাউল বলেন, ‘দুই ভাই মিল্যা কত কষ্ট করি বড় হোইনু, এক সাথেই ছিনু। এ্যাখুন ভাই হারিয়্যা আর ঢাকা যাইতে মন চাহে না। ওখানে কেহু কাহুরি লয়। সুখে-দুঃখে দুটা মনের কথা কার সোথে কোহবো?’
আলাপকালে আশাদুল ইসলাম জানান, তাঁর মা বাড়িতে একটি টিনের ছাপরায় প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে থাকেন। আর এক ভাই থাকেন আরেক ঘরে। বাড়িতে আর কোনো ঘর নেই। এখন মায়ের ঘরেই সবাই মিলে থাকেন অনেক কষ্টে। তবে যতই কষ্ট হোক না কেন, তিনি আর ঢাকায় ফিরে যাবেন না। ঢাকায় গেলে শুধু ছেলের কথা মনে পড়বে। ঢাকার প্রতি মন ভেঙে গেছে তাঁর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবদুর রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে ঢাকায় গুলিতে নিহত দুজন মতিউর রহমান ও মো. তারিক হোসেন এবং আহত পাঁচজনের তালিকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া একজন সমন্বয়কসহ ছাত্র প্রতিনিধিদলের সদস্যরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসে নিহত মতিউর রহমান ও তারিকের কবর জিয়ারত করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে গেছেন। কীভাবে এই পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করা যায়, তাঁরা সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।