ইট বানাতে জমির বারোটা

ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের ক্রসড্যাম এলাকায় এক্সকাভেটর দিয়ে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার তোলা ছবিছবি: প্রথম আলো

ভোলায় আইন লঙ্ঘন করে ফসলি জমির মাটি দিয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি না থাকায় শুধু এক ফসলিই নয়, তিন ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করছে। এতে কৃষিজমির পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনি মাটির উর্বরতা শক্তিও নষ্ট হচ্ছে। ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কাটা বন্ধ না করলে ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা এবং ইটভাটার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় ভোলার ইটভাটার মালিকেরা নদীতীর ও চরের এক ফসলি জমির মাটি সংগ্রহ করে তা দিয়ে ইট তৈরি করতেন। কিন্তু এখন মূল ভূখণ্ডের কৃষিজমির (তিন ফসলি জমি) উপরিভাগ থেকে মাটি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মাটি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ইটভাটার মালিকেরা। মাটি ব্যবসায়ীরে মাটির উপরিভাগের সর্বনিম্ন ৩ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১০ ফুট অংশ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে মাটির উপরিভাগের গুরুত্বপূর্ণ জৈব উপাদান চলে যাওয়ায় উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। ভোলায় প্রতিবছর ১৩০টি ইটভাটায় ইট পোড়ানো জন্য ১৩ কোটি ঘনফুট মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ জন্য প্রতিবছর কমপক্ষে ৪৩২ একর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কৃষিজমির উপরিভাগের (টপ সয়েল) মাটি কেটে নেওয়ার কারণে অত্যাবশ্যকীয় জৈব উপাদানসহ মাটির পুষ্টি উপাদানের চরম ঘাটতি হচ্ছে।
আশিক এলাহী, জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ভোলা মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট

ভোলা সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা এ কে এম শাহাবুদ্দিন বিষয়টিকে কৃষির জন্য অশনিসংকেত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এভাবে অবাধে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়ার কারণে কৃষিজমি ও জমির উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩-এর মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণে ৫–এর (১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলার মাটি কেটে সংগ্রহ করে তা ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যিনি এই আইনের ৫ ধারা লঙ্ঘন করবেন, তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ না থাকায় ইটভাটার মালিক ও মাটি ব্যবসায়ীরা ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কাটা বন্ধ করেননি। এভাবে মাটি কাটায় কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নের বৈরাগীয়া মৌজার হেলিরচর বিলের সব জমি তিন ফসলি। এ বিলে শত বছর ধরে বর্ষায় দুটি ধান এবং রবি মৌসুমে নানা ডালসহ নানা ধরনের ফসলের আবাদ করা হয়। এই বিলের ৩৩ শতাংশ জমি নগদ টাকায় ভাড়া নিয়ে আলু, লাউ, সবজির আবাদ করেছিলেন কৃষক মো. জসিম উদ্দিন (৪৫)। হঠাৎ জমির মালিক ওই জমির মাটি ইটভাটা মালিকের কাছে বিক্রি করে দেন। এক হাজার ঘনফুট মাটি বিক্রি করেছেন, ২ হাজার ৫০০টাকায়। ভাটার মালিক জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভেকু মেশিন ও ট্রাক্টর নিয়ে এসে জসিমের আলুখেতের মাটি কাটা শুরু করে। কৃষক জসিম প্রতিবাদ করলে তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ধরিয়ে দেয়। বিলের মাঝখান দিয়ে মাটি কাটায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ওই বিলের আরও অনেক কৃষক।

পাশের জমির কৃষক মোসলেম শিকদার বলেন, ইটভাটার মালিক আমির হোসেন ভেকু মেশিন দিয়ে এমনভাবে মাটি কাটছে যে তাতে বর্ষা মৌসুমে তাঁর জমি ভেঙে যাবে। আবার মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে নেওয়ার পথে আরও অনেকের ফসলি জমি ও জমির ফসল নষ্ট করেছে। সেখানেও এক-দেড় একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

বিলের একাধিক কৃষক বলেন, আমির হোসেনসহ এ এলাকার ইটভাটার মালিকেরা এ বিলের অনেকের জমি কিনেছেন। মাটি কেটে নিলে পাশের জমি ভেঙে পড়বে। আবার মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাক্টরে অন্যের জমি ও ফসল এমনভাবে নষ্ট করছে, ওই জমিতে নতুন করে আবাদ করতে হলে সড়কের ওপর ফেলানো ইটবালু পরিষ্কার করতে হবে। কারণ রাস্তা টেকসই করার জন্য ইটবালু ফেলা হয়েছে। যে প্রতিবাদ করে, তাকেই কিছু ক্ষতিপূরণ ধরিয়ে দেয়। বেশির ভাগ আবার দেয় না।

এ বিলের কৃষক তৈয়ব আলী হাওলাদার আক্ষেপ করে বলেন, ‘চাষবাস কইররা দুগা ডাইল-বাত খাইতাম, হেও বুজি কপালেত্তোন নাই অইয়া গেল।’

এই জানতে চাইলে ইটভাটার মালিক আমির হোসেন বলেন, জমির মালিক মাটি বিক্রি করলে তিনি কী করতে পারেন। তিনি তো চুরি করে বা জোর করে মাটি নিচ্ছেন না। সঠিক মূল্য ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে মাটি নিচ্ছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তর দিঘলদীর মতো ভোলার সদর উপজেলার পশ্চিম ইলিশা, ভেলুমিয়া ও ভেদুরিয়া, মেহেন্দিগঞ্জের (ভোলাঅংশে) আলিমাবাদ, দৌলতখানের চরপাতা, লালমোহনের লর্ডহার্ডিঞ্জ, রমাগঞ্জ, চরভূতা, পশ্চিম চর উমেদ ও চরফ্যাশন উপজেলার হাজারিগঞ্জ, আসলামপুর, ওমরপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন বিলের তিন ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

মাটি কীভাবে বিক্রি হয়, জানতে চাইলে একাধিক ইটভাটার মালিক ও মাটি বিক্রেতারা জানান, মাটি ব্যবসায়ীরা জমির মালিকদের কাছ থেকে কিনে ইটভাটার মালিকদের কাছে মাটি বিক্রি করেন। বে কারণে ইটভাটার মালিকেরা এক হাজার ঘনফুট মাটি ১৫ হাজার টাকায় কিনলেও জমির মালিকেরা ৩ হাজার টাকার বেশি পান না।

মাটি ব্যবসায়ী কারিগর ও ইটভাটার মালিকেরা আরও জানান, ভোলায় ১ শতাংশ জমি থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ঘনফুট মাটি পাওয়া যায়। প্রতি ইটভাটায় মৌসুমের শুরুতে কমপক্ষে ১০ লাখ ঘনফুট (৩ দশমিক ৩৩ একর জমির) মাটি মজুত করে। সে হিসাবে ভোলার ১৩০টি ইটভাটায় বছরে প্রায় ৪২৯ একর জমির মাটি ইটভাটায় যাচ্ছে। এ ছাড়া ভোলার মাটি ঢাকা, মুন্সিগঞ্জসহ আশপাশের জেলায়ও যাচ্ছে।

ভোলা মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশিক এলাহী বলেন, কৃষিজমির উপরিভাগের (টপ সয়েল) মাটি কেটে নেওয়ার কারণে অত্যাবশ্যকীয় জৈব উপাদানসহ মাটির পুষ্টি উপাদানের চরম ঘাটতি হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে ফসলি জমির উপরিভাগ কেটে নিলে জৈব উপাদানের পরিমাণ শূন্যে চলে আসবে। তখন রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়বে। এতে খাদ্যে পুষ্টিগুণ কমে আসবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ভোলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. হাসান ওয়ারিসুল কবির বলেন, ইটভাটায় জমির উর্বর অংশের মাটির ব্যবহার বন্ধ করা না হলে খাদ্যে উদ্বৃত্ত ভোলা অঞ্চলে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটতে পারে।

ভোলা জেলা প্রশাসক (ডিসি) আরিফুজ্জামান ও ভোলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তোতা মিঞা বলেন, কৃষিজমির মাটি কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত আছে। গত জানুয়ারি ও চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে অভিযান চালিয়ে ছয়টি ইটভাটাকে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।