রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে স্কুল পুনর্মিলনীতে সবাই এক সারিতে

প্রতিষ্ঠার ১৩৭ বছর পর লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের আজ ছিল প্রথম পুনর্মিলনীছবি: প্রথম আলো

সামনের সারিতে পাশাপাশি চেয়ারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন, তাঁর পাশের চেয়ারগুলোতে ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া, বিএনপি নেতা ও সাবেক পৌরসভার মেয়র হাসানুজ্জামান চৌধুরী।

লক্ষ্মীপুরে এমন ঘটনা বিরল। শেষ কবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা এমন পাশাপাশি চেয়ারে বসেছেন, তা অবশ্য কেউ বলতে পারেননি। তবে তাঁদের আজ বুধবার এক হওয়ার কারণ হলো তাঁরা সবাই লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। প্রতিষ্ঠার ১৩৭ বছর পর জেলার ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আজ ছিল প্রথম পুনর্মিলনী। অনুষ্ঠানটি পুনর্মিলনী হলেও রাজনৈতিক নেতাদের কণ্ঠে ছিল বিভাজিত রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ থাকা।

সকাল থেকে বৃষ্টি। তার পরও বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে, আতশবাজি ফুটিয়ে প্রিয় শিক্ষাঙ্গন প্রাঙ্গণে আসতে থাকেন। তাঁরা বলছিলেন, ১৩৭ বছর পর এ পুনর্মিলনী তাঁদের সর্বোচ্চ পাওয়া।

স্কুলটির সাবেক শিক্ষার্থী সংসদ সদস্য নূর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন তাঁর বক্তব্যে বলেন, পুনর্মিলনীতে আমরা রাজনৈতিক বিভাজন চাই না। বিভাজিত রাজনীতিকে দূরে ঠেলে আমরা সামনে এগোতে চাই। বিভাজন নয়, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই। এ অনুষ্ঠান কোনো দলের নয়, দলমতের ঊর্ধ্বে।

অনুষ্ঠানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান আয়োজন করায় আয়োজকদের ধন্যবাদ দেন। ভবিষ্যতে তাঁর দল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামাল স্কুলটিতে যাতে অতিরিক্ত রাজনীতি না হয়, সেই পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, রাজনীতি ঢুকলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো করতে পারে না। তাঁর মতে, স্কুল যত ভালো হবে, তার পণ্যও তত ভালো হবে। এ সময় তিনি একটি কল্যাণ তহবিল গঠনের পরামর্শ দেন। যাতে এ তহবিল থেকে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করা যায়। একই সঙ্গে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল করার তাগিদ দেন তিনি।

মঞ্চে বক্তব্য দেন সাবেক শিক্ষার্থীদের অনেকে
ছবি: প্রথম আলো

১৯৫৭ সালে এ প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক পাস করেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। তিনি দুই বছর পরপর পুনর্মিলনী করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে একটি ট্রাস্ট ফান্ড করার পরামর্শ দেন তিনি।

অনুষ্ঠানস্থলের এদিক–সেদিক হাঁটাহাঁটি করছিলেন নুরুল ইসলাম। তিনি ১৯৬৬ সালে এখান থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি বলছিলেন, বন্ধুদের অনেকে মারা গেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন জীবদ্দশায় যে এমন অনুষ্ঠান দেখে যেতে পারবেন, কল্পনাও করেননি। নবীন প্রবীণের এই মিলনমেলা তাঁর আজীবন মনে থাকবে।

১৯৮১ সালে এ স্কুল থেকে পাস করেন জসীম উদ্দিন। বর্তমানে তিনি রায়পুর রুস্তম আলী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে চার দশক আগে ফিরে গেছি। সেই শ্রেণিকক্ষ, সেই মাঠ। সেই পুকুর যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য চোখে ভাসছে। কৈশোরের সেসব বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে বহু বছর দেখা নেই।’

সকাল ১০টায় অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে কিছুটা দেরিতে শুরু হয়। জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্বাগত বক্তব্য দেন অতিরিক্ত ডিআইজি টুটুল চক্রবর্তী। এরপর অন্যরা বক্তব্য দেন। পরে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা ও উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়।

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারও (বাঁয়ে) এই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী
ছবি: প্রথম আলো

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও পৌর মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূইয়া এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি বলছিলেন, এই জেলার অনেকে ঢাকায় বড় ব্যবসায়ী। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নিজ জেলায় বিনিয়োগ করেন না। তিনি তাদের নিজ জেলায় বিনিয়োগের আহ্বান জানান।

বিএনপি নেতা ও সাবেক পৌরসভার মেয়র হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তাঁর জীবনখাতায় ২০২৪ সাল অম্লান হয়ে থাকবে। এদিনের মতো স্মরণীয় দিন তাঁর জীবনে আসেনি, আসবেও না।

তবে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে আগের সেই জায়গায় নেই, সে কথাও স্মরণ করেছেন কেউ কেউ। সাবেক শিক্ষার্থী এম আর মাসুদ বলেন, এখানে সহশিক্ষা নেই। আগে ছিল। এখন কিশোর গ্যাং ও মাদকে ছেয়ে গেছে। পড়াশোনার মানও পড়তির দিকে। এসব দিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহা বলেন, এটি সারা দেশের মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। যেটি দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করছে। আলো ছড়াচ্ছে।

প্রথমবারের মতো পুনর্মিলনী হওয়ায় সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছলতা ছিল বেশি। স্কুলজীবনের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলেন তাঁরা।

বহু বছর পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যান অনেকে। নিবন্ধিত প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে বেশির ভাগই এসেছিলেন। দিনভর কেটেছে স্মৃতি রোমন্থন ও গান–আড্ডায়। কনসার্টের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।