ঢাকার নবাবগঞ্জ
অযত্নে খেলারাম দাতার কোঠা
ঐতিহাসিক স্থাপনাটির কয়েকটি ঘরের জানালার কাছে রাখা হয়েছে খড়কুটো। যত্রতত্র পড়ে আছে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের প্যাকেট, ময়লা, আবর্জনা।
ইছামতী নদীর তীরে ঢাকার নবাবগঞ্জের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা খেলারাম দাতার কোঠা। মন্দিরসদৃশ কোঠাটি প্রায় সাত বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সংস্কার করা হয়। এরপর স্থাপনাটি সংরক্ষণ ও দেখভালের জন্য তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে দিন দিন জৌলুশ হারাচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপনাটি।
খেলারাম দাতা কোঠা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে এলাকায় নানা কথা প্রচলিত আছে।
কেউ বলেন, খেলারাম ছিলেন জমিদার। কারও মতে, তিনি ভয়ানক দস্যু ছিলেন। তবে খেলারামের দানের হাত ছিল বড়। তিনি ধনীদের কাছ থেকে ডাকাতি করে টাকাপয়সা, মালামাল গরিবদের বিলিয়ে দিতেন। শেষ জীবনে তিনি অতিশয় ধার্মিক ব্যক্তিতে পরিণত হন। কথিত আছে, খেলারাম দাতার বাড়ি থেকে ইছামতীর পাড় পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথ ছিল। নদীপথে ধনসম্পদ এনে এ সুড়ঙ্গ পথেই বাড়ি নিয়ে আসতেন তিনি। নামটি নিয়েও আছে মতভেদ। কেউ বলেন, তাঁর নাম ছিল ‘খেলারাম দত্ত’। কেউ বলেন ‘খেলারাম দাদা’। আর স্থানীয় ব্যক্তিরা বলে থাকেন ‘খেলারাম দাতা’।
অনেকে ভবনে আঁকাআঁকি করে। কেউবা চিপস জুসের প্যাকেট ফেলে নোংরা করে যায়। এতে ভবনের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এগুলো দেখার কেউ নেই।সন্ধ্যা রানী, কোঠার পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা
গত মঙ্গলবার সকালে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা এলাকায় ইছামতী নদীর তীরে সরেজমিনে জানা যায়, খেলারাম দাতার কোঠাটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রায় সাত বছর আগে সংস্কার করেছে। তখন নিয়োগ দেওয়া হয় মতিউর রহমান নামের একজন প্রহরীকে। তিনি কোঠাটি পাহারা দেন।
দেখা যায়, দোতলা ভবনের নিচতলার পূর্ব দিকের একটি কক্ষে বিছানায় শুয়ে আছেন প্রহরী। দোতালার মাঝখানে রয়েছে একটি বড় অষ্টভূজাকৃতির ঘর। এর চারিদিকে রয়েছে আটটি ছোট ঘর। এর মধ্যে কয়েকটি ঘরের জানালার কাছে রাখা হয়েছে খড়কুটা। কক্ষের ফটক বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। ভবনের নিচতলায় স্নানঘর, চৌবাচ্চা।
নিচতলার ঘরে রয়েছে একটি সিঁড়ি, আরও নিচে নামবার জন্য। এখন সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিচতলার ভবনের দেয়ালে দর্শনার্থীদের আঁকিবুঁকির ছাপ। কেউ কেউ নিজের নাম লিখে গেছে। ভবনের নিচতলার দেয়াল জরাজীর্ণ হয়ে সেখানে সবুজ রঙের শেওলা জমে গেছে। এতে ভবনের শ্বেতশুভ্র রং ঢেকে গেছে। যত্রতত্র পড়ে আছে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের প্যাকেট, আবর্জনা।
কথিত আছে, ভবনের নিচতলায় ছিল একটি সুড়ঙ্গ। যে পথে খেলারাম পার্শ্ববর্তী ইছামতী নদীর ঘাট পর্যন্ত চলে যেতে পারতেন। তাঁর ডাকাতির মালামাল নৌকা থেকে সরাসরি এই পথেই নিয়ে আসতে পারতেন। আবার কোনো বিপদ হলে এই পথেই তিনি পালিয়ে যেতে পারতেন নৌকায়। নিচতলার ঘরগুলো ছিল খেলারামের ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখার গুদাম। এই সিঁড়ি ছিল সেই ঘরগুলোতে যাওয়ার জন্য। খেলারাম কোঠার পশ্চিম পাশে বর্গাকার আকৃতির বিশাল পুকুর রয়েছে। খেলারাম এই পুকুর কাটিয়েছিলেন এলাকার মানুষের পানির জোগান দেওয়ার জন্য। এই পুকুরে সাধারণ মানুষ এসে কিছু চাইলে তা নাকি পূরণ হতো।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খেলারাম যতই ডাকাত সর্দার থাকুন না কেন, তিনি ছিলের ভীষণ রকমের মা ভক্ত। মা যা চাইতেন, আদেশ করতেন, তাই পালন করতেন খেলারাম।
কোঠার পাশে বসবাসরত সন্ধ্যা রানী বলেন, খেলারাম দাতা কোঠা দেখতে প্রতিদিন অনেক মানুষ ভিড় করে। তবে কেউ নিয়ম রক্ষা করে না। অনেকে ভবনে আঁকাআঁকি করে। কেউবা চিপস জুসের প্যাকেট ফেলে নোংরা করে যায়। এতে ভবনের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এগুলো দেখার কেউ নেই। ভবনের দেয়াল দীর্ঘদিন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন না করায় সেখানে শেওলা পড়ে গেছে। সরকারের উচিত ভবনটি সুন্দরভাবে দেখেশুনে রাখা।
কথা হয়, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা দর্শনার্থী কামরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রাচীন স্থাপত্য খেলারাম দাতার কোঠা সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জেনেছি। পরবর্তী সময়ে বন্ধুদের নিয়ে এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখতে এসেছি।এখানে অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে। কোঠার পরিবেশ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন নয়।’
নিরাপত্তা প্রহরী মতিউর রহমান বলেন, ‘সন্ধ্যার পর এই এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে এখানকার কক্ষে রাত্রি যাপন করতে হয়। এটি রক্ষার স্বার্থে লোকবল বাড়ানো দরকার।’
সম্প্রতি খেলারাম দাতা কোঠা পরিদর্শন করে গেছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান। তিনি বলেন, কোঠাটি একটি মন্দির স্থাপনা। এ জায়গার প্রকৃত মালিক কারা ছিলেন সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ স্থাপনার জায়গা কাউকে দখল করতে দেওয়া হবে না। কাগজপত্র ও দলিলাদি যাচাই–বাছাই করে ঐতিহাসিক নির্দশন হিসেবে এ স্থাপনা ও পুকুরটিকে পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।