কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে স্বপ্নপূরণে ছুটছে তারা

এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে কলেজে পড়ার খরচ নিয়ে। উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশসেবা করতে চায় তারা।

অভাব–অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা তাদের। নানা সংকটের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে গেলেও তাদের সামনে বাধা হয়ে এসেছিল এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা। কারও মা মুরগি বিক্রি করে মেয়েকে ফরম পূরণের টাকা দিয়েছেন। কেউ নিজে শিক্ষার্থী পড়িয়ে জমানো টাকা খরচ করেছে ফরম পূরণের জন্য। কারও বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ফরম পূরণের টাকা নেননি।

এভাবেই এবারে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ–৫ পেয়েছে নীলফামারীর সুলতানা আক্তার, রাজবাড়ীর জাকিয়া আক্তার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রমা রানী কর্মকার ও রংপুরের ছিয়াম বাবু। এই সাফল্য ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে চায় তারা। তবে স্বপ্নপূরণের জন্য কলেজে পড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে তাদের পরিবার।

মায়ের মুরগি বেচে ফরম পূরণ

‘আমি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। সুলতানার বাবা কোনো লেখাপড়াই জানেন না। অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর চেষ্টা করছি। মেয়ের ফরম পূরণের টাকা ছিল না। তখন ডিম দেওয়া মুরগি বাচ্চাসহ দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করি। ওই টাকার সঙ্গে আরও ৭০০ টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করাই।’

কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারী জেলা সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের উত্তর কানিয়াল খাতা আদর্শ ফকিরপাড়া গ্রামের গৃহিণী সামছুন নাহার। তাঁর মেয়ে সুলতানা আক্তার এবারের এসএসসি পরীক্ষায় নীলফামারী ছমির উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু অভাবের সংসারে এখন মেয়েকে কলেজে পড়ানোর খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করেছে।

সুলতানার বাবা মো. সিরাজুল ইসলাম বাইসাইকেলে ফেরি করে গ্রামে সবজি বিক্রির টাকায় সংসার চালান। এক ভাই এক বোনের মধ্যে সুলতানা আক্তার ছোট। বড় ভাই শামীম ইসলাম আলিম শ্রেণিতে পড়েন।

বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব চার কিলোমিটার হলেও টাকার অভাবে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়েছে সুলতানাকে। সে বলে, ‘এখন আমি একটা ভালো কলেজে ভর্তি হতে চাই। আরও ভালো ফল করে চিকিৎসক হতে চাই। আমাদের মতো অসচ্ছল পরিবারের জন্য কিছু করতে চাই।’

বাবা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়ে ভালো ফল করেছে। ও ডাক্তার হতে চায়; কিন্তু মেয়েকে বাইরে পড়ানোর মতো সামর্থ্য আমার নেই।’

সব বিষয়ে জিপিএ–৫ নিয়েও দুশ্চিন্তা

‘কোনো দিন বাবার আদর–ভালোবাসা পাইনি। মামাদের ভালোবাসা আর সহযোগিতায় এ পর্যন্ত এসেছি। ভালো কিছু করতে হলে ভালো কলেজে পড়াশোনা করতে হবে। এ জন্য প্রতি মাসে অনেক টাকা দরকার। এই টাকার জোগান কীভাবে হবে, সেই শঙ্কায় আছি।’

কথাগুলো বলছিল রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা মোছা. জাকিয়া আক্তার। সে গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ–৫ পেয়েছে।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, জাকিয়া আক্তারের বয়স যখন মাত্র ১০ মাস, তখন বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। এরপর নানাবাড়িতে মামাদের তুলে দেওয়া টিনের দোচালা ঘরে ঠাঁই হয় মা–মেয়ের। একমাত্র মেয়ে জাকিয়াকে নিয়ে নতুন সংগ্রাম শুরু হয় চাম্পা খাতুনের। তাঁর ছোট ভাই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেনের দেওয়া খরচে পড়াশোনা চলে জাকিয়ার। চাম্পাও বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন করে মেয়েকে বড় করেন।

চাম্পা খাতুন বলেন, ‘কোনো দিন মেয়ের মুখে ভালো খাবার তুলে দিতে পারিনি। নিজে কষ্ট করে সামর্থ্য অনুযায়ী যা পেরেছি দিয়েছি। পাশাপাশি ও নিজেও কিছু করার চেষ্টা করেছে।’

জাকিয়া বলে, ‘অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় করোনা শুরু হলে এলাকার শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ মেটাতাম। স্বপ্ন দেখেছি বড় চিকিৎসক হব, দরিদ্র মানুষকে বিনা মূল্যে সেবা দেব।’

ধার করা বই পড়ে সাফল্য

দিনমজুর বাবার আয়ে তিন বেলার খাবার জোটানোই দায়। পড়াশোনার খরচ চালাতে তাই টিউশনি শুরু করে প্রমা রানী কর্মকার। নিজে প্রাইভেট পড়তে পারেনি। নিজের জমানো ও বাবার ঋণের টাকায় এসএসসির ফরম পূরণ করে সে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার সুহাতা গ্রামের মেয়ে প্রমা। উপজেলার ভোলাচং উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। উচ্চশিক্ষা নিতে হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হতে হবে; কিন্তু কলেজে ভর্তি এবং শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ জোগানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় তার পরিবার।

প্রমা কর্মকার বলে, ‘টাকার জন্য সব বই কেনাও হয়নি। অন্যদের কাছ থেকে বই এনে পড়তাম। বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিত টেস্ট পেপার ধার করে এনে পড়েছি। এসএসসি পরীক্ষার আগে পুরোনো টেস্টপেপার সংগ্রহ করে পড়েছি। তবে মেইন বই বেশি পড়েছি।’ সে আরও জানায়, বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বিনা মূল্যে পড়িয়েছেন। আরেক শিক্ষক অর্ধেক বেতনে পড়িয়েছেন। কোনো মাসে দিতে পারত না। এভাবে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে জানায়, উচ্চশিক্ষা নিয়ে সে চিকিৎসক হতে চায়।

প্রমার বাবা শিবলু চন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘একটি দোকানে লোহার কাজ করি। দৈনিক বেতন ৪০০ টাকা। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি, ঋণ করে চলছি। খরচ বাঁচাতে মেয়ে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে বিদ্যালয়ে গেছে। মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

কঠিন পথ পেরিয়ে সাফল্য

ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় ভালো ছিয়াম বাবু। কিন্তু প্রায়ই খাতা, কলম ও বই কেনার টাকা জুটত না। স্কুল বন্ধ হলে বাবার সঙ্গে অন্যের জমিতে কাজ করতে যেত। যা আয় হতো, তা দিয়ে লেখাপড়া খরচ চালাত। স্কুলের শিক্ষকেরাও তার পরীক্ষার ফি-স্কুলের বেতন মওকুফ করেছেন। ফরম পূরণের টাকা নেননি। এমন কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে ছিয়াম।

সে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের চাপড়ারপার গ্রামের দিনমজুর ছাইফুল ইসলামের ছেলে। স্থানীয় ডাঙ্গীরহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল।

ছাইফুল ইসলামের সহায়-সম্পত্তি বলতে ভিটেবাড়ির ৪ শতক ও আবাদি ৩০ শতক জমি। দুটি দোচালা ঘরে মাথা গুঁজে থাকে তারা তিন ভাই-বোন ও বাবা-মা। ছাইফুল শারীরিকভাবে অসুস্থ, তবু অন্যের বাড়িতে শ্রমিকের কাজ করেন। প্রতিদিন কাজ মেলে না। ছিয়ামকেও সপ্তাহে দুই দিন বাবার সঙ্গে কাজ করতে হয়।

ছিয়ামের মা মোবাশ্বেরা খাতুন বলেন, ‘ছাওয়াটা মোর ডাকতোর হবার চায়; কিন্তু হামার তো দুই বেলা খাবার জোটে না। ছাওয়াটাক ফির কেমন করি ডাকতোর বানামো কন?’

ডাঙ্গীরহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষক রফিকুল সরকার বলেন, ‘আমি জানতাম, ছেলেটা ভালো ফল করবে; কিন্তু এত ভালো করবে, তা কল্পনাও করতে পারি নাই। আমি দেশের সবার কাছে ছেলেটার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাই।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, প্রতিনিধি, নীলফামারী, রাজবাড়ীতারাগঞ্জ, রংপুর]