অনুষ্ঠান থেকে বাদ ১৫ শিল্পী–কলাকুশলী, অনিয়ম নিয়ে লিখিত অভিযোগ

কক্সবাজার বেতার কেন্দ্র।ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার বেতারকেন্দ্রের তালিকাভুক্ত বংশীবাদক রেজাউল করিম। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এক দশকের বেশি সময় ধরে নিয়মিত বাজাতেন বেতারের অনুষ্ঠানে। সম্প্রতি তিনি আর বেতারে যাচ্ছেন না। হঠাৎ তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু রেজাউল নন, আরও ১৪ সংগীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী, উপস্থাপক ও সংবাদপাঠককে অনুষ্ঠান পরিচালনা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ তোলা হয়েছে জুলাই আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে।

তবে শিল্পীদের অভিযোগ, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কক্সবাজার বেতারে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়েছে। এই সিন্ডিকেট নির্ধারণ করছে কারা বেতারে অনুষ্ঠান করতে পারবেন, আর কারা পারবেন না। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার পরও শিল্পীদের বাদ দেওয়া হয়েছে কেবল সিন্ডিকেটটি নিজেদের পছন্দের লোকজনকে বেতারে কাজ দেবে বলে। বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক (আরডি) আশরাফ কবিরও তাঁদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সরকারি এই গণমাধ্যম শ্রোতাদের আস্থা হারাচ্ছে। এ নিয়ে শিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠান থেকে বাদ পড়া শিল্পী ও কলাকুশলীদের একটি দল এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা, বেতারের মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরে। অভিযোগপত্রে আশরাফ কবির ও তাঁর সহযোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির ১২টি অভিযোগ তোলা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ কবির সাড়ে তিন বছর ধরে কক্সবাজার বেতারকেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন। এ সময় তিনি সংগীত সংকলক মোসলেহ উদ্দিন (সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন) ও ক্যাজুয়াল স্টাফ (হিসাব সহকারী) নুরুল আজিমকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গঠন করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৪০ কর্মী নিয়োগে টাকা লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগপত্রে বেতারের আঞ্চলিক পরিচালকের বিরুদ্ধে ইউনিসেফের প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি ডরমিটরিতে বিনা ভাড়ায় বসবাস, বেতারকেন্দ্রের জমিতে চাষাবাদ ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত খামার পরিচালনা, কেন্দ্রের গাছ কেটে বিক্রি ও শিল্পীদের সম্মানীর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও আনা হয়েছে।

শিল্পীরা অভিযোগ করেছেন, এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তাঁদের ১৫ জনকে অনুষ্ঠান পরিচালনা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। বাদ পড়া শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার বেতারের সংগীতশিল্পী ও নাট্য প্রযোজক দ্বীপলাল চক্রবর্তী ও শিল্পী ফরমান উল্লাহ।

দ্বীপলাল চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সম্মানের কথা ভেবে বেতারে যাই। কিন্তু আরডি শিল্পীদের সম্মান দেখান না। কোন শিল্পীকে ডাকবেন, সেটা নির্ভর করে সিন্ডিকেটের ওপর।’ তিনি আরও বলেন, ‘১০ বছরের বেশি সময় ধরে বংশীবাদক হিসেবে কাজ করতেন প্রতিবন্ধী রেজাউল করিম। তাঁকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে শিল্পীদের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে।’

জেলা সংগীতশিল্পী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ফরমান উল্লাহ অভিযোগ করেন, ‘শিল্পীদের সম্মানীর টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও নিয়মিত কারচুপি হয়। মাসের পর মাস রেকর্ডিংয়ের টাকা দেওয়া হয় না। ইউনিসেফ প্রকল্প থেকেও লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।’

অভিযোগে বলা হয়, আশরাফ কবির কক্সবাজারে যোগ দেওয়ার সময় তথ্যমন্ত্রী ছিলেন হাছান মাহমুদ। সাবেক তথ্যমন্ত্রীর বাবার গাড়িচালক মো. নাসিরকে বেতারের গাড়িচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ শুরু থেকেই দুজন গাড়িচালক ছিলেন কক্সবাজার বেতারে। ফলে কোনো কাজ করতে হতো না মো. নাসিরকে। কাজ না করেও আড়াই বছর ধরে নিয়মিত বেতন–ভাতা পেয়েছেন তিনি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁর নিয়োগ বাতিল হয়।

বিষয়টি স্বীকার করেন মো. নাসির নিজেও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন বেতারে গিয়ে বসে থাকতে হতো। আড়াই বছরে মাত্র পাঁচবার গাড়ি চালিয়েছি।’

এ ছাড়া শাহাব উদ্দিন নামের এক ছাত্র প্রতিনিধির সই জাল করে রিদোয়ানুল করিম নামে এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল সম্প্রতি। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে রিদোয়ানুলকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে কর্মচারী রিদোয়ানুল করিম আরডির বিরুদ্ধে শহরে মানববন্ধন করেন।

অভিযোগের বিষয়ে আশরাফ কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব অভিযোগই ভিত্তিহীন। চালক মো. নাসিরকে চাকরি দিয়েছিলেন তৎকালীন ডিজি।’ ১৫ শিল্পীকে অনুষ্ঠান থেকে বিরত রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় তাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এক সমন্বয়ক ও জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও (জাসাস) তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এ জন্যই তাঁদের অনুষ্ঠান থেকে সরানো হয়েছে। তা ছাড়া শিল্পী ফরমান উল্লাহ একটি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি।’

আশরাফ কবির আরও বলেন, কক্সবাজারে তাঁর চাকরির বয়স সাড়ে তিন বছর হয়ে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর বদলি হওয়ার কথা। তিনি নিজেও বদলি হতে চেষ্টা করছেন।