কাজে আসছে না ৯ কোটি টাকার ১২ রেডিও স্টেশন
কৃষির নানা তথ্য, আবহাওয়া ও নদ–নদীর তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে ১২ জেলায় চালু করা হয় রেডিও স্টেশন।
কৃষকের কাছে আবহাওয়া ও নদ-নদীর নির্ভরযোগ্য তথ্য দেওয়ার জন্য দুই বছর আগে দেশের ১২ জেলায় রেডিও স্টেশন স্থাপন করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বর্তমানে ১০টি স্টেশন অচল পড়ে আছে। কোনোটিতে ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়েছে, কোনোটিতে অকেজো হয়েছে কম্পিউটার। দুটি স্টেশন চলছে অনিয়মিতভাবে। ফলে এসব স্টেশন কাজেই আসছে না।
‘কৃষি আবহাওয়া তথ্যপদ্ধতি উন্নতকরণ’ প্রকল্পের আওতায় এসব কমিউনিটি রেডিও স্থাপন করা হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের জুনে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। এতে ব্যয় হয়েছে ২১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ১২টি রেডিও স্টেশন স্থাপন বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিলের মধ্যে এসব স্টেশন স্থাপন করা হয়। এরপর শুরু হয় সম্প্রচার। তবে একটানা চলেনি। চলেছে অনিয়মিতভাবে। এর মধ্যে কোনোটি ৯ মাস, কোনোটি ৬ মাস ধরে বন্ধ।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার, কুমিল্লা, সিলেট, খুলনা, রংপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও ও বরিশালে রেডিও স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে নেওয়া হয়েছে রেডিও পরিচালনার জন্য তরঙ্গ বরাদ্দ। রেডিও স্টেশন স্থাপনের কাজ করেছে আব্দুল মোনেম লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সার্ভিক ইঞ্জিন লিমিটেড। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিলের মধ্যে এসব স্টেশন স্থাপন করা হয়। এরপর শুরু হয় সম্প্রচার। তবে একটানা চলেনি। চলেছে অনিয়মিতভাবে। এর মধ্যে কোনোটি ৯ মাস, কোনোটি ৬ মাস ধরে বন্ধ। যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া ও দক্ষ জনবলের অভাবে মূলত স্টেশনগুলো পড়ে আছে।
রেডিও স্টেশনগুলো কাজে না আসার কারণ হিসেবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন কোন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে, কীভাবে অনুষ্ঠান সাজানো হবে, সম্পাদনা কে করবে—এসব কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। রেডিও স্টেশন পরিচালনায় দক্ষ জনবলও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। প্রকল্প থেকে একজন করে টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্প শেষ হওয়ায় ছয়টি স্টেশনে ওই টেকনিশিয়ান যাচ্ছেন না। এতে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে।
রেডিও স্টেশনের কম্পিউটার ঠিকভাবে কাজ করছে না। পাশাপাশি টেকনিশিয়ানও নিয়মিত স্টেশনে যাচ্ছেন না। এ কারণে সম্প্রচার বন্ধ।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম
রেডিওগুলো বসানো হয়েছে কৃষকদের তথ্য দেওয়ার জন্য। গত এক মাসে ১২ জেলায় কমপক্ষে ৩০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা কখনো এই রেডিওর কোনো সম্প্রচারই শোনেননি। এমনকি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যে রেডিও চালু করেছে, এমন তথ্যও জানেন না সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসরত বেশির ভাগ কৃষি উদ্যোক্তা ও কৃষকেরা।
সংশ্লিষ্ট এলাকার কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, রেডিও স্টেশন চালু করার প্রকল্পটি সরকারি অর্থ গচ্চা দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এসব রেডিও ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শোনা যায় না। বসানো হয়েছে শহরের মধ্যে।
রেডিও স্টেশন কাজে না আসা ও অচল পড়ে থাকার বিষয়ে কথা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রেডিও চালু না থাকার বিষয়টি তিনি জানেন না। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে কথা বলবেন। কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
নষ্ট ট্রান্সমিটার, বন্ধ হয়ে যায় কম্পিউটার
প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই সিলেট শহরের ধোপাদিঘির পাড়ে বসানো স্টেশনের ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে গেছে। গত বছরের এপ্রিলে এটি নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা। এ কারণে স্টেশনটি বন্ধ।
কুমিল্লার শাসনগাছায় স্থাপিত রেডিও স্টেশনটিও গত জুলাই থেকে বন্ধ। ওই এলাকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুবীর কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, রেডিও স্টেশনের কম্পিউটার ঠিকভাবে কাজ করছে না। পাশাপাশি টেকনিশিয়ানও নিয়মিত স্টেশনে যাচ্ছেন না। এ কারণে সম্প্রচার বন্ধ।
এই রেডিও স্টেশনে টেকনিশিয়ানের কাজ করেছেন সুহেল আহমেদ। তিনি জানান, রেডিও চালু হলেও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। এটি সার্ভিক ইঞ্জিন লিমিটেডের প্রকৌশলী পবিত্র কুমার সাহাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো মেরামত করা হয়নি। এ ছাড়া বেতন বন্ধ থাকায় তিনি বর্তমানে স্টেশনে যাচ্ছেন না।
রাঙামাটির রেডিও স্টেশনটি গত ৪ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। জেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনিসুর রহমান সম্প্রচার বন্ধ থাকার বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, স্টেশনের কম্পিউটার চালু হয়। তবে রেডিওর সফটওয়্যারে ঢুকলেই কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে পড়ে আছে স্টেশনটি।
জনবলের অভাবে বন্ধ সাত স্টেশন
জনবলের অভাবে রেডিও সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার, পাবনা, রংপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও ও বরিশাল অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে টেকনিশিয়ান আর স্টেশনে যাননি। ফলে সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার এন্ডারসন সড়কে বসানো হয়েছে ওই এলাকার রেডিও স্টেশন। এটিও গত আগস্ট থেকে বন্ধ আছে। কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল কুমার প্রামাণিক বলেন, রেডিও স্টেশন চালানোর জন্য প্রকল্প থেকে একজন টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। গত আগস্ট থেকে ওই টেকনিশিয়ান আর আসছেন না। ফলে এটি বন্ধ আছে।
স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষে পাবনায় রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে। সর্বশেষ গত জুনে রেডিও সম্প্রচার করা হয়েছে। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, লোকবল–সংকটের কারণে রেডিও সম্প্রচার সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কৃষকেরা তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একই কথা বলেন রংপুর, ঠাকুরগাঁও, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তারাও।
জনবলের অভাবে রেডিও সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার, পাবনা, রংপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও ও বরিশাল অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
রেডিও স্টেশন বন্ধ থাকার বিষয়ে কয়েক দফায় কথা হয় ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ’ প্রকল্পের পরিচালক মো. শাহ কামাল খানের সঙ্গে। মুঠোফোনে তিনি বলেন, প্রতিটি রেডিও স্টেশন চালু রয়েছে। নিয়মিত সম্প্রচারও হচ্ছে। তবে সর্বশেষ কবে সম্প্রচার হয়েছে, এমন প্রশ্ন করলে তিনি খোঁজ নিয়ে জানানোর কথা বলেন। কিন্তু এরপর আর জানাননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী ও খুলনায় স্থাপিত রেডিও স্টেশনে অনিয়মিতভাবে সম্প্রচার হয়। তবে অনুষ্ঠান গৎবাঁধা। বাংলাদেশ কৃষি আবহাওয়া তথ্য সেবা (বামিস) নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে আবহাওয়া ও কৃষিসম্পর্কিত তথ্য নিয়ে পড়া হয়। ফাঁকে ফাঁকে বাজানো হয় দেশাত্মবোধক গান।
রেডিও স্টেশন থেকে চার কিলোমিটার দূরে রাজশাহী শহরের মহিষবাথান এলাকার কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, তিনি কোনো দিন এই রেডিওর সম্প্রচার শোনেনি। রেডিওটির সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
প্রশিক্ষণের ফল নিয়ে প্রশ্ন
রেডিও স্টেশনের সম্প্রচার চালু রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার দুজন করে কৃষি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প থেকেই ওই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সার্ভিক ইঞ্জিন লিমিটেডের কর্মকর্তা ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ওই প্রশিক্ষণ দেন। কিন্তু কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশিক্ষণ কাজে আসেনি। তিন দিনে তাঁরা প্রাথমিক তথ্য পেয়েছেন শুধু।
২০২৩ সালের ২১ মার্চ চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে তিন দিনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে কক্সবাজার, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের দুজন করে কৃষি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। রেডিও সম্প্রচার করার দায়িত্ব এসব কর্মকর্তার। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের একজন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে রেডিও সম্প্রচার চালু করার প্রাথমিক ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ঘাটতি থেকে গেছে। এ কারণে তাঁরা রেডিও চালাতে পারছেন না।
রেডিও পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালে তিন দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রাসেল ইসলাম ও ভান্ডাররক্ষক মো. মিজানুর রহমান। তাঁরা জানান, তিন দিনের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট ছিল না। সেখানে কথা রেকর্ড করে সম্প্রচারের পদ্ধতি হাতে-কলমে শেখানো হয়নি। তাঁরা কেবল চালু ও বন্ধ করা শিখেছেন।
কমিউনিটি রেডিও নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি)। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এ এইচ এম বজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রেডিও শোনার চল এখন কমে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যানেও বিষয়টি উঠে এসেছে। মানুষ মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত। ফলে ঠিক কী উদ্দেশে এসব রেডিও স্থাপন করা হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলে এসব রেডিও চালানো যাবে না। স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠন ও ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করে এসব রেডিও চালাতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে দক্ষ জনবল।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা)