খাগড়াছড়ির ‘প্রাণ’ চেঙ্গী নদী দখল-দূষণে মুমূর্ষু

চেঙ্গী নদীর পানির প্রবাহ কমে গেলে সংকটে পড়বে কাপ্তাই হ্রদ। কাপ্তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা।

চেঙ্গীর নদীর এক পাড়ে ভাঙছে। অন্য পাড়ে চলছে দখল। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে বসতঘর। খাগড়াছড়ি সদরের উত্তর গঞ্জপাড়া থেকে সম্প্রতি তোলাছবি: সুপ্রিয় চাকমা

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির প্রাণ বলা হয় চেঙ্গী নদীকে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা এই নদী শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এখানকার মানুষের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এই নদীতে ফুল ভাসিয়ে নিজেদের বর্ষবরণ আয়োজন শুরু করে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী।

দেশের অন্যান্য নদীর মতো পাহাড়ি এই নদীতে চোখ পড়েছে দখলদারদের। জেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর জায়গা দখল করে ঘরবাড়ি, দোকানপাট করেছেন লোকজন। তাঁদের অনেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নদীভাঙনের শিকার হয়ে এখানে ঠাঁই নিয়েছেন। করেছেন বসতঘর।

আবার নদীতে দেওয়া হয়েছে রাবার ড্যাম। শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজের জন্য পানি প্রত্যাহারে অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয় নদীর বিভিন্ন জায়গায়। পলি জমে নিয়মিত ভরাট হচ্ছে নদী। কমছে গভীরতা। হ্রাস পেয়েছে পানির ধারণক্ষমতাও। বর্ষাকালে বন্যার সময় ভাঙনের তীব্রতাও বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। নদীর ওপর অত্যাচার এখানে থেমে নেই। দখল ও ভাঙনের পাশাপাশি দূষণও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর খনন এবং ভাঙন রোধে একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও মাঝপথে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

জেলার প্রধান নদীর মতো শহরের প্রধান খালও দখল-দূষণের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত। খাগড়াছড়ি খাল নামের এই খালের জায়গা দখল করে বিপণিবিতান, আবাসিক ভবন, হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করেছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের অবকাঠামোর কারণে খাল সংকুচিত হয়েছে। পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই শহরে জলজট হচ্ছে।

প্রধান নদী ও খালের ওপর এমন ‘অত্যাচারের’ প্রতিদান দিতে শুরু করেছে প্রকৃতি। পাহাড়ি জনপদে গত বছর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়। জেলা শহরসহ আশপাশের উপজেলাগুলোও পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।

শুধু চেঙ্গী নদী নয়, দখল হচ্ছে খাগড়াছড়ি শহরের পানিনিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খাগড়াছড়ি খালও। বিপণিবিতানের প্রতিরোধদেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে খালের জায়গায়। খাগড়াছড়ি সদর থেকে সম্প্রতি তোলা
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

নদী-খাল নিয়ে এমন অবহেলা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নদী গবেষকেরা। তাঁদের মতে, চেঙ্গী দেশের সবচেয়ে বড় হ্রদ কাপ্তাই হ্রদেরও পানির অন্যতম উৎস। চেঙ্গী নদী থেকে পানি না এলে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই নদী রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়ির পানছড়ি থেকে উৎপত্তি হওয়া চেঙ্গী নদী খাগড়াছড়ি সদর, মহালছড়ির মধ্যে প্রবাহিত হয়ে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার মধ্যে কাপ্তাই হ্রদে মিলিত হয়েছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য ৯৭ কিলোমিটার।

আর খাগড়াছড়ি খাল জেলার পূর্ব পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে চেঙ্গী নদীতে মিশেছে। সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের প্রস্থ কোথাও ৪০ মিটার, আবার কোথাও ১৫-২০ মিটার। চেঙ্গী নদী যেসব উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সেগুলোতে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ লোকের বসতি রয়েছে।

চেঙ্গীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব

চাকমা ভাষায় চেঙ্গী বা চেঙেই হচ্ছে এক প্রকার ছোট আকারের বিশেষ উদ্ভিদ, যা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। পাহাড়ি জনপদের মানুষের সঙ্গে এই নদী জড়িয়ে আছে সুদীর্ঘকাল থেকে। ২২৭ বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে চট্টগ্রামে মসলা চাষ সম্ভব কি না, সেটি যাচাই করতে এসেছিলেন ফ্রান্সিস বুকানন। তখন তিনি চট্টগ্রামসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলও ভ্রমণ করেছিলেন।

দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন বইয়ে ফ্রান্সিস বুকানন চেঙ্গীকে চিমি বা চিংগি উল্লেখ করেছিলেন। ১৭৯৮ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি চেঙ্গী নদীতে আসেন। তিনি লিখেছেন, চেঙ্গীর দুধারে চাকমারা বসবাস করতেন। চেঙ্গী ধরে উজানে গেলে অনেকগুলো ছোট নদী দেখেছিলেন বুকানন। নদীগুলোর নামও লিপিবদ্ধ করেছিলেন তিনি।

গবেষক সুগত চাকমার মতে, পাহাড়ি জনপদের বিশেষ করে খাগড়াছড়ির মানুষের জন্য চেঙ্গী নদী গুরুত্বপূর্ণ। তিনি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার চাকমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘খাগড়াছড়ি জেলার ইতিহাস, বিভিন্ন উপজাতীয় পূর্বপুরুষদের বসতি স্থাপন, জুম ও জমিতে লাঙ্গল/হাল দিয়ে চাষাবাদকরণে এসবের ক্ষেত্রে চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীসহ অপরাপর ছোট–বড় সব নদীগুলোর অশেষ অবদান রয়েছে।’

কাগজে-কলমে দখলদার ৩২, বাস্তবে আরও বেশি

খাগড়াছড়ি জেলার ভেতর দিয়ে ৮টি নদী প্রবাহিত হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই জেলায় খাল রয়েছে ৮৮টি। ছয় বছর আগে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন জেলার প্রধান নদী চেঙ্গী ও প্রধান খাল খাগড়াছড়ি খালের দখলদারদের তালিকা করে। প্রশাসনের মতে, অন্য নদীগুলোতে দখল নেই।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড চেঙ্গী নদী ও খাগড়াছড়ি খালের দখলদার তালিকা করেছে ছয় বছর আগে। তিন সংস্থার তালিকায় মোট ৩১ ব্যক্তি ও ১টি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে দখলদার হিসেবে। এর মধ্যে চেঙ্গী নদী দখল করে স্থাপনা করেছেন ২০ ব্যক্তি। খাগড়াছড়ি খালের জায়গা দখল করেছে ১১ ব্যক্তি ও ১টি প্রতিষ্ঠান। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে জেলার গুরুত্বপূর্ণ নদী ও খালের দখলদার তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। জেলা সদরের উত্তর গঞ্জপাড়ায় ১৪ ব্যক্তি এবং পানছড়ি উপজেলার পানছড়ি বাজারে ৬ ব্যক্তি নদীর জায়গা দখল করে ঘরবাড়ি করেছেন।

এই তালিকা ধরে গত ২১ আগস্ট জেলা সদরের উত্তর গঞ্জপাড়ায় সরেজমিনে যান প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী।

তালিকায় ১৪ জন দখলকারীর কথা বলা হলেও বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি। স্থানীয় বাসিন্দা, ঘর নির্মাণকারী ব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন, শুধু ১৪ জন নয়, এ রকম শত শত মানুষ নদীর তীর ঘেঁষে থাকা সরকারি জায়গায় ঘর নির্মাণ করেছেন। তাঁদের কেউ আগে থেকে দখল করে রাখা ব্যক্তিদের থেকে জায়গা কিনে ঘর করেছেন। কেউ কেউ নিজেরাই জায়গা দখলের মাধ্যমে ঘর করে বসবাস করছেন।

২০১৯ সালে নদীর জায়গা দখলকারীদের তালিকা করার পরও নতুন করে ঘর নির্মাণ বন্ধ হয়নি। এই সময়ে এক থেকে দেড় শ ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, খালের পাড় ঘেঁষে সারি সারি ঘর। প্রায় অধিকাংশ ঘর টিনের তৈরি। কিছু কিছু ঘর আধা পাকা। পাড়ার ভেতরে ইটের রাস্তাও নির্মাণ করা হয়েছে। রয়েছে বিদ্যুতের সংযোগও। ঘর নির্মাণকারী ব্যক্তিদের প্রায় সবাই স্বল্প আয়ের মানুষ। তাঁদের অধিকাংশ দিনমজুর ও শ্রমিক। কেউ কেউ রিকশা, ভ্যান চালান। কারও দোকান রয়েছে।

খাগড়াছড়ির প্রধান নদী চেঙ্গী নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে বসতঘর ও দোকানপাট। সদরের উত্তরগঞ্জ পাড়া থেকে সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

নদীর জায়গা দখলে নদীভাঙনের শিকার ব্যক্তিরা

খাগড়াছড়ি সদরের উত্তর গঞ্জপাড়ায় যাঁরা বাড়িঘর করেছেন, তাঁদের অনেকেই আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন। বরিশাল, ভোলা, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে পাহাড়ে চলে আসেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। তাঁরা কেউ অন্যের কাছ থেকে জায়গা কিনে, কেউ দখল করে বসতি স্থাপন করেছেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকায় প্রথমে আছে জেলা সদরের উত্তর গঞ্জপাড়ার সামছুল হকের নাম। ভোলার লালমোহন এলাকার বাসিন্দা তিনি। প্রায় ৪৫ বছর আগে গ্রামের বাড়িঘর ও জায়গাজমি সব নদীভাঙনে তলিয়ে যায়। সর্বস্ব হারিয়ে চলে আসেন পাহাড়ের এই জেলায়। এখন টিনের ঘর করেছেন চেঙ্গী নদীর পাড়ে। স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনি নিয়ে থাকেন। তবে বাড়িতে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

কথা হয় সামছুল হকের স্ত্রী বিবি আয়েশার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৮০ সালের দিকে লালমোহনে তাঁদের ও শ্বশুরবাড়ির জায়গাজমি ও বাড়িঘর সব নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তারপর প্রথমে ঢাকায়, পরে খাগড়াছড়িতে চলে আসেন। এখানে এসে মুসলিমপাড়ায় ছিলেন। ২০০১ সালে উত্তর গঞ্জপাড়ায় জায়গা কিনে ঘর করেন। তবে জায়গার কোনো কাগজপত্র নেই, দখলিস্বত্ব কিনেছেন তাঁর স্বামী। এখানে যাঁরা ঘর করেছেন, জমি কিনেছেন, তাঁদের প্রায় সবারই কারও কোনো কাগজপত্র নেই।

এই বৃদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, গ্রামের বাড়িতে নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকা ঘুরে পাহাড়ে এসেছেন। কিন্তু এখানেও এসে ভাঙনের ঝুঁকিতে আছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টে ঘর করেছি। কিন্তু কখন নদী ভেঙে নিয়ে যায়, কখন সরকার ভেঙে দেয়, এই আতঙ্কে থাকি সব সময়। এখনো ভাঙনের মুখে আছি।’

দখলদারের তালিকায় আছেন আমিনুল মাঝি। তিনি বিবি আয়েশার আপন বড় ভাই। তাঁর বাড়িতে গেলে কথা হয় পুত্রবধূ রিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর শ্বশুরের পরিবার আট বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন। আগে টিনের ঘর থাকলেও তা ভেঙে তিন বছর আগে আধা পাকা ঘর করেছেন।

দুই পরিবারের সদস্যরা জানান, শহরের অন্য কোথাও জায়গা কেনার সামর্থ্য তাঁদের নেই। তাই বাধ্য হয়ে সরকারি জায়গায় বসত করেছেন।

নদীর জায়গা দখলের তালিকায় আছে নাছির উদ্দিনের নাম। নদীর পাশে তাঁর আধা পাকা ঘর। সামনে মুদিদোকান। ভেতরে থাকার ঘর। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২০১১ সালে তিন লাখ টাকায় ৭ গন্ডা জায়গা কিনেছেন। আগে টিনের ঘর ছিল। পানি ওঠার কারণে ২০২২ সালে উঁচু করে নতুন ঘর নির্মাণ করেছেন।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা নাছির উদ্দিন জানান, তিনি ব্যবসার জন্য এই শহরে এসেছেন। তবে তাঁর প্রতিবেশীদের অধিকাংশ এসেছেন বরিশাল, ভোলা, যশোর ও খুলনা অঞ্চল থেকে। মূলত নদী-সাগরের ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে তাঁরা এখানে বসতি করেছেন।

দখল–দূষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভাঙন। প্রতিবছর বর্ষায় বন্যার সময় নদীর দুই পারেই ভাঙছে চেঙ্গী নদী। বেড়িবাঁধ বা ব্লক না থাকায় ভাঙনের ঘটনা বাড়ছে। খাগড়াছড়ির গঞ্জপাড়া থেকে তোলা
ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান

নাছির উদ্দিনের পাশে আধা পাকা বাড়ি করেছেন শুক্কুর আলী। তবে তাঁর পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।

দখলের তালিকায় এসব ব্যক্তির নাম থাকলেও তাঁদের প্রতিবেশী খাদিজা আক্তারের নাম নেই। তিনি টিনের ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন এক পরিবারকে। একই ভাবে নদীর পাশে ঘর করা নূর মোহাম্মদের নামও নেই দখলের তালিকায়।

সরকারি জায়গায় ঘর করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রবীণ নূর মোহাম্মদ। তাঁর আদি বাড়ি নড়াইল। তিনিও ঘরবাড়ি হারিয়ে ৪০ বছর আগে খাগড়াছড়িতে চলে এসেছিলেন। প্রথমে মাটিরাঙ্গায় থাকতেন। কিন্তু সেখানে জীবিকা অর্জনের জন্য তেমন কোনো পেশা ছিল না। পরে জীবিকার তাগিদে ২৫ বছর আগে খাগড়াছড়ি শহরে চলে আসেন। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। এখন বয়সের কারণে কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না।

নূর মোহাম্মদ বলেন, ২০-২৫ বছর আগে এখানে চর ছিল। মানুষ সরকারি জায়গায় বাড়িঘর করেছেন। কেউ কেউ আগে থেকে দখল করেছেন। কেউ কেউ দখলকারীদের কাছ থেকে কাগজ কিনেছেন। ২২ একর ৭৭ শতক জায়গায় ৮০০–৯০০ পরিবার আছে। এর মধ্যে গত চার-পাঁচ বছরের ৩০০ বাড়ি নতুন করে নির্মিত হয়েছে।

চারজন বাসিন্দার সবাই বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নদীভাঙন আর বন্যার প্রকোপ বেড়ে গেছে। একেকবার বন্যা হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের ঘরবাড়ি ডুবে যায়। তখন নদী ছাপিয়ে কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত পানি ওঠে। ঘরের জিনিসপত্র সব নষ্ট হয়ে যায়। ওই সময় ঘরে থাকা আর সম্ভব হয় না। প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে অন্য এলাকার আত্মীয়স্বজন, বিদ্যালয় ভবনে আশ্রয় নেন। নদীর পাশে যদি শক্ত দেয়াল দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, নদীর জায়গা দখল করে যাঁরা ঘর করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ মানুষ নদীভাঙনের শিকার।

৪০ জায়গায় ভাঙছে নদী, মৃতপ্রায় ছড়া-খালও

দেশের অবৈধ দখলদারত্ব এবং দূষণ থেকে রক্ষা এবং নদীর তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য ২০২২ সালে সমীক্ষা করেছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এর আওতায় ৪৮টি নদী ছিল। একটি ছিল চেঙ্গী নদী।

ওই সমীক্ষায় চেঙ্গী নদীর ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। নদীর অন্তত ৪০টি জায়গায় তীব্র ভাঙন হয়। এসব স্থান প্রায় প্রতিবছরই ভাঙে। দফায় দফায় ভাঙনের কারণে ৫ বছরে নদীর ১২ হাজার ৩৮০ মিটার জায়গায় ভেঙেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মহালছড়ির চৌংড়াছড়ি এলাকায় ৫ বছরের ব্যবধানে ৮ থেকে ১০ বার করে ভেঙেছিল। একই উপজেলার ক্যায়াংঘাট ইউনিয়নের ছয়টি স্থান ভাঙনের শিকার হয়েছিল ৬ থেকে ১০ বার করে। অর্থাৎ বছরে দুবারও ভেঙেছিল একই জায়গা।

পানছড়ি উপজেলার অন্তত ৮টি স্থান ভাঙনকবলিত। এর মধ্যে পানছড়ি সদর, চেঙ্গী, লতিবান ও লোগাং এলাকা বেশি ভেঙেছে।

সবচেয়ে বেশি ভাঙনের ঘটনা ঘটে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায়। এই উপজেলার ২০টি স্থানে প্রতিবছর নিয়ম করে ভাঙে নদী। সদর উপজেলার গোলাবাড়ি ও ভাইবোন ছড়া ইউনিয়নে প্রতিবছর ভাঙছে নদী।

উত্তর গঞ্জপাড়ার বিপরীত পাশে শান্তিনগর এলাকা। নদীর ঘাটে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ নুরুল হুদার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে যেখানে কথা হয়, সেখানে গত বছরের বন্যার সময় পানির স্রোতে রাস্তা ভেঙে গেছে। রাস্তাটি এখনো সংস্কার করা হয়নি। তিনি বলেন, উত্তর গঞ্জপাড়ায় যেখানে ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে, একসময় সেখানে নদী ছিল। পরে নদীর বাঁক পরিবর্তন হয়ে মোড় নেয়। এরপর সেখানে চর জমতে শুরু করে। তবে কয়েক বছর ধরে নদীর দুই পারেই ভাঙন শুরু হয়েছে। তাঁদের দিকেও ভাঙছে।

বারবার নদীভাঙনের কারণে কৃষিজমির ক্ষতি হচ্ছে বেশি। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে মানুষের জায়গাজমি। অনেকের চাষের জমিও নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বন্যার সময় তীব্র স্রোতের কারণে স্থানীয় রাস্তাঘাটও ভেঙে যাচ্ছে।

চেঙ্গী নদীর সঙ্গে যুক্ত আছে ১০০ খাল ও ছড়া। এসব ছড়ার মধ্যে ৯টির প্রবেশমুখ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রবাহ নেই ৩টিতে। নিয়মিত ভাঙন হচ্ছে ২৪টিতে। আংশিক ভরাট হয়েছে ৪টি ছড়া ও খাল। শুষ্ক মৌসুমে কার্যত মৃত থাকে ২৪ ছড়া-খাল।

চেঙ্গী নদীর ভাঙনে কৃষিজমি হারানোর কথা জানান পানছড়ি উপজেলার পুচগাঙ ইউনিয়নের কিনাচান পাড়ার বাসিন্দা রেলি চাকমা। তিনি বলেন, একসময় নদী তাঁদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিল। এখন ভাঙতে ভাঙতে ঘরের দুয়ারে চলে এসেছে। ছোটবেলায় তেমন বন্যা হতো না। এখন নিয়মিত বন্যা হচ্ছে।

মাঝপথে বন্ধ খননকাজ

খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ি খরস্রোতা চেঙ্গী, মাইনী ও অন্যান্য নদী-ছড়ার ভাঙন থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় এবং খননের জন্য ‘খাগড়াছড়ি শহর ও তৎসংলগ্ন অবকাঠামো নদীভাঙন থেকে সংরক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫৮৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ।

বর্তমানে চেঙ্গী নদী খননের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী তানজির সাইফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চেঙ্গী নদী খননের জন্য দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে প্রতিষ্ঠান দুটি কাজ করতে পারেনি। এর মধ্যে একটির চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। আরেকটির বাতিল করা হচ্ছে। এখন নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। ভাঙন রোধে নদীর ১০ কিলোমিটার অংশে ব্লক দেওয়ার কাজ চলমান রয়েছে। নদী খনন করা হলে এবং চর অপসারণের কাজ শেষ হলে সুফল পাওয়া যাবে। আগের মতো বন্যা হবে না।

চেঙ্গী নদী নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন রাঙামাটি জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেওয়া চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে নৌপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য খনন এবং নদী শাসন করার অনুরোধ জানান তিনি। এ ছাড়া পানিপ্রবাহ ঠিক রাখার জন্য নদীর উৎসমুখগুলো ছড়া, ঝিরি, নালা খনন করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন।

দখলের সঙ্গে রয়েছে দূষণও

‘খাগড়াছড়ি জেলার চেঙ্গী নদীর পানির গুণগত মান এবং মাছের বৈচিত্র্য’ শীর্ষক একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুলশান আরা লতিফা, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. হুমায়ুন কবির।

২০১৯ সালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে খাগড়াছড়ির প্রধান নদীর দখল ও দূষণ নিয়ে উৎকণ্ঠার চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, চেঙ্গী নদী খাগড়াছড়ি জেলার একটি প্রধান নদী। এই নদী স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ উৎস—পানীয় জল, কৃষি সেচ, মৎস্য চাষ, গৃহস্থালি ব্যবহারসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত নদী ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ও মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে এর পানির মান দ্রুত অবনতি ঘটছে। নদীতে মাছের প্রজাতির সংখ্যা কমছে। বিশেষ করে ছোট প্রজাতির আধিক্য। কিন্তু বড় ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।

গবেষণার জন্য তিনটি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন গবেষকেরা। এতে পানির পিএইচ (পানির মান নির্দেশক) ছিল ৯ দশমিক ১ থেকে ৯ দশমিক ৭। অথচ নিরাপদ সীমা হচ্ছে ৬ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫। এত উচ্চ ক্ষারত্বে মাছের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

একই গবেষণায় পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) পাওয়া যায় ৫ দশমিক ৩ থেকে ৫ দশমিক ৮, যা থাকা উচিত ৬ দশমিক ৫-এর ওপর। অক্সিজেন কমে গেলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা কঠিন।

প্রতিনিয়ত বর্জ্য নিক্ষেপ, পয়োবর্জ্য ফেলা, ঝুলন্ত শৌচাগার, কসাইখানার বর্জ্য, ক্রমাগত নদীর জায়গা দখলের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

প্রতিবছর বন্যায় ভাঙছে খাগড়াছড়ির প্রধান নদী চেঙ্গী। নদীর পানির স্রোতে ভেঙে গেছে পাশের সড়ক। এখন গাড়ি চলাচল বন্ধ। খাগড়াছড়ি সদরের শান্তিনগর এলাকা থেকে সম্প্রতি তোলা
ছবি: জুয়েল শীল

শহরের প্রধান খালেও দখলের থাবা

এদিকে খাগড়াছড়ি শহরের ভেতর প্রবাহিত খাগড়াছড়ি খালের জায়গায় বিপণিবিতানের জন্য সুরক্ষাবেষ্টনী দিয়েছেন মোহাম্মদ সেলিম নামের স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ী। খালের পাশে রয়েছে তাঁর সেলিম ট্রেড সেন্টার নামের সবচেয়ে বড় বিপণিবিতান।

এ ছাড়া শহরের ভাঙা ব্রিজ থেকে চাকমা শ্মশান পর্যন্ত অংশে খালের জায়গা দখল করে দোস্ত মো. চৌধুরী বোর্ডিং, নুরুল আলম পাকা দালান, ছালেহ আহমেদ হোটেল, মো. আবুল কাশেম রোগ নিরূপণ কেন্দ্র, মধুসূদন দে ভবন, হারুনুর রশিদ ইলেকট্রনিক পণ্যের শোরুম, গাজী শহীদ সীমানাদেয়াল, রাজমিস্ত্রি সমবায় সমিতি দালান নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া মাস্টারপাড়ায় সীমানাদেয়াল দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। মুসলিমপাড়ায় ভবন করেছেন বাবুল নাগ ও মো. নেছার উদ্দিন। তবে খালের মহাজনপাড়া, মাস্টারপাড়া, পানখাইয়াপাড়ায়ও দখল করে স্থাপনা রয়েছে।

তবে খাল দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সেলিম ট্রেড সেন্টারের মালিক মোহাম্মদ সেলিম।

খাগড়াছড়ি খালের পাশে বাড়ি রয়েছে এমন এক বাসিন্দা বলেন, খালের জায়গা দখল করে নানা ধরনের স্থাপনা করা হয়েছে। কেউ কেউ খালের ভেতরেই সুরক্ষাবেষ্টনী দিয়েছেন। এতে তাঁদের জায়গা সুরক্ষিত হলেও আশপাশের অরক্ষিত অংশ পানির চাপে ভেঙে যাচ্ছে। আবার দখলের কারণে এখন বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

খাগড়াছড়ি খাল দখলের কারণে শহরে জলাবদ্ধতা হওয়ার বিষয়টি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেছেন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম এন আবছার।

[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জয়ন্তী দেওয়ান]

চেঙ্গী নিয়ে বড় শঙ্কা

মো. মনজুরুল কিবরীয়া

দেশের সবচেয়ে বড় হ্রদ কাপ্তাই হ্রদের পানির উৎস চারটি নদী। এর একটি হচ্ছে চেঙ্গী। অথচ চেঙ্গী নদীর উজানে পানি প্রত্যাহার, তামাক চাষ, রাবার ড্যাম, স্লুইসগেটসহ নানা ধরনের পরিবেশবিরোধী কাজকর্ম চলছে। এসব কাজে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে নদীর সঙ্গে যুক্ত ছড়া ও খালগুলোও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

 চেঙ্গী নদীতে পানির প্রবাহ কমে গেলে কাপ্তাই হ্রদে পানির সংকট হবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে পাহাড় ক্ষয়ে আসা মাটি-বালুতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে নদীর গভীরতা কমেছে। পানির ধারণক্ষমতাও কমে গেছে। কিন্তু বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেনি বরং বেড়েছে। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে খাগড়াছড়িতে এখন নিয়মিত বন্যা হচ্ছে।

 হৃদ্‌যন্ত্র যেমন শরীরকে সচল ও সুস্থ রাখে, তেমনি একটি নদী একটি লোকালয়কে সচল রাখে। যদি কোনো কারণে হৃদ্‌যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা অসুস্থ হয়, তাহলে ধীরে ধীরে পুরো শরীর অচল হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি নদী যদি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ওই অঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। তাই খাগড়াছড়ির প্রধান নদী চেঙ্গী রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বিকল্প নেই।

  • মো. মনজুরুল কিবরীয়া, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়