সবজি চাষে সফল সফিকুল

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক সফিকুল ইসলাম। তিনি বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন।

বিক্রির জন্য জমি থেকে লাউ সংগ্রহ করছেন কৃষক সফিকুল ইসলাম। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি
দিনার মাহমুদ

১৯৮৮ সাল। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের কৃষক লোকমান হেকিমের বাড়িঘরেও বন্যার পানি। খাবার নেই, খাওয়ার বিশুদ্ধ পানি নেই, নিরাপদে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এ রকম এক প্রতিকূল পরিবেশে লোকমান হেকিম ও সখিনা বেগম দম্পতির ঘরে আসে তাঁদের প্রথম সন্তান সফিকুল ইসলাম।

জন্মের পর থেকে বহু বছর সফিকুলকে অভাব তাড়া করেছে। অভাবের কারণেই দশম শ্রেণির পড়ালেখার পাট চুকিয়ে সফিকুল কারখানায় কাজ শুরু করেন। অথচ সেই সফিকুলের নাম আজ তাঁর গ্রামের সবার মুখে মুখে। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে তিনি দারিদ্র্য জয় করেছেন। তাঁর জমিতে হওয়া লাউ যাচ্ছে বিদেশে। তাঁর দেখাদেখি এলাকার অনেকেই সবজি চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। এ কারণেই কৃষিতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্প্রসারণে উদ্বুদ্ধ করে তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২৫ (ব্রোঞ্জপদক)। আজ আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। বৈরী পরিবেশ আর অভাবের সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়া সফিকুলের এই গল্প অনেককেই পরিশ্রম করে দারিদ্র্য দূর করার বিষয়ে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

সফিকুলের বাড়িতে একদিন

আড়াইহাজার উপজেলার সরাবদী আতাদি গ্রামে সফিকুলের বাড়ি। টিনের বেড়া দেওয়া বাড়িতে দুটি চৌচালা টিনের ঘর। গোয়ালে গরু। বাড়ির উঠানে ছাগল ও হাঁস-মুরগির বিচরণ। এরই মধ্যে সফিকুলের দেখা মেলে। মাঠ থেকে তুলে আনা লাউ বিক্রির জন্য হাটে পাঠাচ্ছিলেন তিনি। কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

সফিকুল জানান, শৈশবে বাবার সঙ্গে কাজ করতে করতে কৃষিতে হাতেখড়ি। ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করার। তবে সামর্থ্য ছিল না। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় অর্থাভাবে বিদ্যালয় ছাড়েন। যোগ দেন স্থানীয় একটি স্পিনিং মিলে। প্রতিদিন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হতো। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর সামান্য আয়, তার ওপর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। সফিকুল সিদ্ধান্ত নেন, চাকরি ছেড়ে নিজেই আয়ের ব্যবস্থা করবেন।

কৃষিকাজ শুরু করার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে সফিকুল জানালেন, ‘এটা ২০০৮ সালের কথা। আমরা পাঁচ ভাই-বোন বাবার কাছ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ি আর ১৫ শতাংশ ফসলি জমি পেয়েছি। কৃষিকাজ শুরু করার মতো নিজের জমি নেই। গ্রামে তখন ১ বিঘা খালি জমি পাই। সেই পরিত্যক্ত জমির মধ্যেই প্রথম সবজি উৎপাদন শুরু করি।’

সফিকুল জানান, শুরুতে চাকরির পাশাপাশি সবজি উৎপাদন করতেন। তখন ভোর হওয়ার আগেই জমিতে কাজ শুরু করতেন। রাতে বাড়ি ফিরে আবার জমিতে ছুটে যেতেন। এরই মধ্যে তাঁর মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। নানা কারণেই শেষ পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া হয় না। শুরুর বছর জমিতে বোনা ফসলের ব্যাপক উৎপাদন হয়। সফিক গ্রামে থেকে কৃষিকাজ করার সিদ্ধান্তে স্থির হন। প্রায় শূন্য হাতে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পাঁচ বিঘা জমি ধারে লিজ নিয়ে সবজি উৎপাদন শুরু করেন। এক বছর পর সবজি উৎপাদন করে জমি লিজের টাকাসহ উৎপাদন খরচ পরিশোধ করেন। দ্বিতীয় বছরেই তৎকালীন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল কাদিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আবদুল কাদিরের সাহায্যে তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন শুরু করেন।