শুধু মাকে খুঁজছে ১৯ মাসের আয়ুষ্মান দাস

মায়ের সঙ্গে শিশু আয়ুষ্মান দাসছবি: সংগৃহীত

জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত ১৯ মাসের আয়ুষ্মান দাসকে বাসায় মা–বাবার কাছে রেখে গত মঙ্গলবার অফিসে গিয়েছিলেন মাগুরা জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা অনামিকা দাস (৩৪)। সন্ধ্যায় একটি বৈঠক চলাকালে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তির পর জ্ঞান ফিরলে অসুস্থ ছেলের কথা ভেবে বাসায় ফিরে যান তিনি। বুধবার দুপুরে তিনি মারা যান। এখন শুধু মাকে খুঁজছে ছোট্ট আয়ুষ্মান।

২০১৯ সালে ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে মাগুরায় কর্মজীবন শুরু করেন রাজবাড়ী সদরের বানিবহ গ্রামের নির্মল কুমার দাসের মেয়ে অনামিকা দাস। ২০২২ সালের মার্চে একই এলাকার কৌশিক কুমার দাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কৌশিক বর্তমানে খুলনায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই দম্পতির ছেলে আয়ুষ্মানের জন্ম হয়। ঘরে শিশুসন্তান রেখে চাকরি চালিয়ে যেতে রাজবাড়ী থেকে মা–বাবাকে মাগুরায় নিয়ে আসেন এই নারী।

গত বছরের আগস্টের পর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তার পাশাপাশি পদাধিকার বলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্যসচিবের দায়িত্ব পান অনামিকা। দুই কার্যালয়ের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছিল তাঁকে। গত মঙ্গলবার সকালে জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত ছেলেকে বাসায় রেখে কার্যালয়ে আসেন অনামিকা। বিকেলে বাসায় ফিরে আবার সন্ধ্যায় স্টেডিয়ামের সম্মেলনকক্ষে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পূর্বনির্ধারিত একটি বৈঠকে যোগ দেন। জেলা প্রশাসক ও ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক মো. অহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে চলা ওই বৈঠকের মাঝপথে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান অনামিকা।

ঘটনার পরপরই মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয় অনামিকাকে। চিকিৎসকেরা প্রথমে ধারণা করেছিলেন তিনি রক্তশূন্যতায় ভুগছেন। সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসায় জ্ঞান ফিরে আসে অনামিকার। চিকিৎসকেরা তাঁকে রাতে হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরামর্শ দিলেও ছেলের অসুস্থতার কথা ভেবে রাতেই তিনি বাসায় চলে যান।

মাগুরা জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা অনামিকা দাস
ছবি: সংগৃহীত

অনামিকার বাবা নির্মল কুমার দাস জানান, বুধবার সকালে মেয়েকে নিয়ে আবার হাসপাতালে যান। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসককে না পেয়ে অফিসে যান অনামিকা। ওই দিন ইনডোর স্টেডিয়ামে জেলা ক্রীড়া কার্যালয়ের আয়োজনে একটি সার্টিফিকেট বিতরণী অনুষ্ঠান ও একটি খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল অনামিকার। কিন্তু অসুস্থতার কারণে অন্যদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অনামিকা বাসায় চলে আসেন। দুপুরে বাসায় মৃত্যু হয় তাঁর।

অনামিকার স্বামী কৌশিক কুমার দাস বলেন, ‘আমার সঙ্গে মোবাইলে সর্বশেষ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কথা হয়। তখনো সে প্রায় স্বাভাবিক। আমাকে বলছিল, তার খুব ঘুম পাচ্ছে। ছেলে খুব বিরক্ত করছিল। বলেছিল বিকেলে টেস্ট করাতে আবার হাসপাতালে যাবে। এর কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যুর খবর পাই।’

চিকিৎসকদের ধারণা, তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে মারা যেতে পারেন। মাগুরার সিভিল সার্জন শামীম কবির বলেন, ‘প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল রক্তশূন্যতা আছে। কিন্তু মাথায় কোনো সমস্যা হচ্ছে, এমন তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। তিনি সুস্থ হয়ে যাওয়ায় ওই দিন পরিবার বা চিকিৎসকেরা অন্য কোনো আশঙ্কার কথা ভাবেননি। এমন কিছু হলে আমরা বড় কোনো হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতাম।’

মৃত্যুর পর বুধবার অনামিকার মরদেহ রাজবাড়ীতে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনেরা। সেখানে রাতে তাঁর শেষকৃত্য হয়। তাঁর মৃত্যুতে মাগুরায় তাঁর সহকর্মী ও ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শোক প্রকাশ করেছেন। জেলা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে শোকবার্তা জানানো হয়। জেলা প্রশাসক মো. অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অনামিকা দাস কর্মজীবনে সততা, নিষ্ঠা, পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। জেলার ক্রীড়াঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

অনামিকার বাবা নির্মল কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই শোক সহ্য করব কীভাবে? ছেলে আয়ুষ্মান শুধু তার মাকে খুঁজছে। ওর মা যে ঘরে থাকত, শুধু সেই ঘরে যাচ্ছে। মায়ের বুকের দুধ খাওয়া ১৯ মাসের এই শিশুকে এখনো আমরা কিছু খাওয়াতে পারছি না। ছেলেটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাকে হারাল। মেয়েটা নিজের চেয়ে ছেলে আর আমাদের কথাই ভাবত। অফিসের সব কাজও নিষ্ঠার সঙ্গে করত।’