‘সোনার জন্য গ্রামের সবাই মাটি খুঁড়ছে তো খুঁড়ছেই’

সোনার আশায় এক সপ্তাহ ধরে ইটভাটায় স্তূপ করা মাটি খুঁড়ে যাচ্ছেন নানা বয়সী নারী, পুরুষ আর শিশুরা। গতকাল শুক্রবার ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাজোর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

গ্রামীণ পাকা সড়কের পাশে থরে থরে সাজানো কাঁচা ইট। পাশেই ধোঁয়া ছড়িয়ে চুল্লিতে পুড়ছে সেগুলো। চুল্লি ঘিরে মাটির ঢিবি। সেই ঢিবির মাটি খুঁড়লেই মিলছে সোনা—এমন খবরে কোদাল, খুনতি, শাবল, বসিলা নিয়ে দিন-রাত সোনা খুঁজে চলছেন গ্রামবাসী।

এক সপ্তাহ ধরে এমন হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাজোর এলাকার ‘আরবি ব্রিকস’ নামের একটি ইটভাটায়।

স্থানীয় লোকজন বলেন, ইটের কাঁচামাল হিসেবে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ভাটায় স্তূপ করে কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি সেই মাটি কাটতে গিয়ে শ্রমিকেরা সোনা পেয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে কোদাল, খুনতি, শাবল, বসিলা নিয়ে সেখানে ভিড় করতে শুরু করেন গ্রামবাসী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর পেয়ে আশপাশের এলাকা এমনকি দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন এসে সেখানে ভিড় করছেন।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, ওই ভাটার মাটির ঢিবি খুঁড়তে এসে কেউ কেউ সোনা পাচ্ছেন। তবে কে কে সোনা পেয়েছেন, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি।

গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মাটির ঢিবিতে অসংখ্য নারী, পুরুষ, শিশু মাটি খোঁড়ার যন্ত্র দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলেছেন। কোনো দানাদার বস্তু পেলেই, তা যাচাই করে দেখছেন। ইটভাটার সামনে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী খাবারের দোকান। জ্যৈষ্ঠের গরমে ঘামঝরা দেহে স্বস্তি এনে দিতে অনেকেই সেখানে ছুটছেন। চা-বিস্কুট মুখে নিয়ে আবার ফিরে আসছেন মাটির ঢিবিতে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সেখানে চলছিল নানা গালগল্প। রাজোর গ্রামের বাসিন্দা শচীন রায় বলেন, ‘কয়েক দিন থেকে এইঠে মেলা লাগি গেইছে। সোনার খোঁজে কুনঠে কুনঠে থাকিয়া লোক আসছে, কহিবা পারো না।’

স্থানীয় লোকজনের দাবি, ওই ভাটার মাটির ঢিবি খুঁড়তে এসে কেউ কেউ সোনা পাচ্ছেন। তবে কে কে সোনা পেয়েছেন, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। গতকাল শুক্রবার ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাজোর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

চায়ের দোকানি লালন বর্মণ বলেন, ‘অ্যালাতো লোক কম। রাইতত আসেন, দেখিবেন কত লোক।’ এরপর মুচকি হেসে বললেন, ‘লোকলা সোনা পাছে কি না কহিবা পারু না। তবে মোর কেনাবেচা ভালোই হচ্চে।’

নাজমুল হোসেন নামের স্থানীয় এক সংবাদকর্মী বলেন, সন্ধ্যা গড়ালেই মানুষজন হাতে টর্চলাইট, চার্জার লাইট, হারিকেন নিয়ে চলে আসেন ইটভাটায়। রাতের আঁধারে ভাটার মাটির ঢিবি জোনাকি পোকার মতো জ্বলজ্বল করে। সোনা খোঁজার এ কর্মযজ্ঞ চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

ভাটাটির পাশের গ্রামে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ এলাকার তৌহিদুল ইসলামের মেয়ের বাড়ি। ঘটনাটি শুনে তিনি গতকাল এখানে ছুটে এসেছেন। সেখানে গিয়ে নিজেও মাটি খুঁড়তে শুরু করেন। ঘণ্টা দু-এক চেষ্টার পর নিরাশ হয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সোনার জন্য গ্রামের সবাই মাটি খুঁড়ছে তো খুঁড়ছেই। শুনছি, কেউ কেউ সোনার ঢিকা পাচ্ছে। আমিও চেষ্টা করে দেখলাম। কই কিছুই পেলাম না।’

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজোর গ্রামের গৃহিণী জয়ন্তী রানী বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘ভোর থাকিয়া একটানা মাটি খুঁড়েছি। শরীরখান আর চলে না। অ্যালা বাড়ি চলে যাছি। সন্ধ্যার পর আবার আসিবা হবে।’ কেউ কি সোনা পেয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘না পাইলে অ্যাতলা লোক কেনে এইঠে আসেছে। পাইলেও কেউ কহিবা চাহে না।’

রানীশংকৈলের গোপীনাথপুর গ্রামের সুশেন রায় মাটি খুঁড়ছেন আর তাঁর দুই ভাতিজা সেগুলোয় সোনা খুঁজে দেখছেন। খুঁড়তে খুঁড়তে তিনি বুক পর্যন্ত গর্ত করে ফেলেছেন। মাটি খোঁড়ার একফাঁকে সুশেন রায় বললেন, ‘সোনার খোঁজে চার দিন ধরে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছি। কিন্তু কপালে নাই।’ বলতে বলতে কোদাল চালাতে লাগলেন তিনি।

শত শত মানুষ মাটি খুঁড়তে থাকায় তাঁদের নিষেধ করা যাচ্ছেন না বলে জানান রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিতেন্দ্র নাথ বর্মণ। তিনি বলেন, রাত-দিন পরিশ্রমের পর তাঁরা নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।

তবে রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম বলেন, ভাটাটির ওই এলাকায় চার হাজার বছরের পুরোনো বাংলা গড়ের স্থাপনা আছে। সেসব এলাকার মাটিতে সোনা পাওয়া গেলে তা অস্বাভাবিক কিছু না। প্রথম দিকে ভাটার মাটিতে কেউ না কেউ সোনা পেতেও পারেন। কিন্তু এখন যেটা ঘটছে, সেটা অস্বাভাবিক।

ইটভাটাটি দেখভাল করেন মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এবার কাতিহার এলাকার সামরাই মন্দিরের পাশ থেকে মাটি কেটে ভাটায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ওই মাটির স্তূপ থেকে নাকি সোনা পাওয়া গেছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় এলাকার মানুষ এসে রাত-দিন মাটি খোঁড়া শুরু করেন। কেউ সোনা পেয়েছেন, এমন কোনো সত্যতা নেই।

ঘটনাটি শোনার পর সেখানে গিয়ে সোনা পাওয়ার কোনো প্রমাণ পাননি জানিয়ে রানীশংকৈল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রকিবুল হাসান বলেন, ‘সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা যেন না ঘটে, আমরা সেদিকে নজর রেখেছি।’