বিপুল ব্যয়েও দূর হয়নি জলাবদ্ধতা

ছড়াগুলোতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও ড্রেনে ধীরগতিতে উন্নয়নকাজ চলায় পানি চলাচলের পথ রুদ্ধ হওয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।

ভারী বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় সিলেট নগরে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। সম্প্রতি শাহজালাল উপশহরে
আনিস মাহমুদ

ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে সিলেট নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, ১৩ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কী লাভ হলো। এত টাকা ব্যয় করেও সমাধান না হওয়ায় বিশেষজ্ঞসহ অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলছেন।

১৭ জুলাই মধ্যরাতের ভারী বর্ষণে নগরের অর্ধশতাধিক এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে কোথাও গোড়ালি, আবার কোথাও হাঁটু পর্যন্ত পানি ওঠে। পরদিন ভোরের দিকে সেই পানি নেমে যায়। সর্বশেষ গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় একইভাবে ভারী বৃষ্টিতে আখালিয়া, কালীবাড়িসহ নগরের কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জোর আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অনেকেই লিখেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন প্রকল্পের পর প্রকল্প নিলেও তা পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাননি নগরবাসী।

পরিকল্পিতভাবে ছড়া খনন ও সংস্কার করা না হলে দুর্ভোগ কমবে না।
মুশতাক আহমেদ, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যদি ছড়াগুলো পরিকল্পিতভাবে গভীর করার পাশাপাশি অবৈধ দখলমুক্ত করে খনন করা হতো, তাহলে নগরের জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না। নগরে প্রবাহিত ছড়াগুলো যথাযথ খননের অভাবে পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। এতে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। এ ছাড়া অনেক জায়গায় ছড়ার তীরে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ না করে, সেসব জায়গায় সিটি কর্তৃপক্ষ গার্ডওয়াল দিয়ে তাঁদের স্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার সুযোগ করে দিয়েছে।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নগরের ভেতর দিয়ে ১১টি ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) প্রবাহিত হচ্ছে। ছড়াগুলোর ১৬টি শাখা খাল আছে। সেগুলো মিশেছে সুরমা নদীতে। বৃষ্টির পানি ছড়া দিয়ে নদীতে চলে যায়। সব মিলিয়ে ছড়া ও খালের দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে নগরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা নর্দমা আছে ৬৫০ কিলোমিটার।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল সূত্রে জানা গেছে, ভারী বর্ষণে নগরে যেন জলাবদ্ধতা দেখা না দেয়, সে জন্য চলতি বছর ২০৯ কোটি টাকার কাজ করছে সিটি করপোরেশন। গত ১২ বছরে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৮৬৯ কোটি টাকা। কাজের মধ্যে ছড়া খনন, প্রশস্তকরণ ও দখলমুক্ত করা; রিটেনিং ওয়াল, ইউ টাইপ ড্রেন, ওয়াকওয়ে ও বক্স কালভার্ট নির্মাণ উল্লেখযোগ্য।

প্রধানত তিন কারণে স্বল্প সময়ের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন নগরের একাধিক বাসিন্দা। তাঁরা জানান, ছড়াগুলোতে অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজ ও নর্দমার উন্নয়নকাজ ধীরগতিতে চলায় পানি চলাচলের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হওয়া এবং ছড়া-নর্দমার তলদেশে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্যে ভরাট হওয়ার কারণে এ জলাবদ্ধতা হয়েছে। কোথাও কোথাও ছড়ার উপরিভাগ ঢেকে ‘বক্স কালভার্ট’ নির্মাণ করায় পানিপ্রবাহের গতি আরও রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, জুনের মাঝামাঝি সিলেটে যে বন্যা হয়েছিল, তখন উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নগরের নালা-নর্দমায় পলি জমেছে। পাশাপাশি অনেক নর্দমা বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে তা অপসারণ করা যায়নি। এ জন্য অল্প সময়ের বৃষ্টিতে গতকাল নগরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

জলাবদ্ধতা নিরসনে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নকাজ চলছে দাবি করেন নূর আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, অতীতে সামান্য বৃষ্টিতে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিত, এখন সেটা হচ্ছে না। এ ছাড়া নগরের ছড়া ও নালা-নর্দমাগুলো পরিচ্ছন্ন করার পাশাপাশি অসম্পন্ন কাজ দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজগুলো শেষ হলে জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেকটাই নিরসন হবে। এ ছাড়া ছড়ার তীর থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করেই গার্ডওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

নগরের সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতা নিয়ে গত মঙ্গলবার দুপুরে সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগর ভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি দাবি করেন, অপরিকল্পিতভাবে কিংবা মনগড়াভাবে উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে, এমনটি নয়। মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। তবে এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর দুই মাস আগে থেকেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কিছু কাজ বাকি রয়েছিল। ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ শেষ না হওয়ায় কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমেদ গতকাল রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে ছড়া খনন ও সংস্কার করা না হলে দুর্ভোগ কমবে না। ছড়ার উপরিভাগে বক্স কালভার্ট নির্মাণ না করলেই ভালো হতো। ছড়ার কোন কোন জায়গায় পানি আটকাচ্ছে, কোথায় পানি বের হওয়ার পথ নেই, জরিপ করে এসব স্থান চিহ্নিত করে পরিকল্পিতভাবে খনন করতে হবে।