কাজের খোঁজে কৃষি শ্রমিকেরা 

রংপুরে ফসল ওঠার আগে, বিশেষ করে বোরো ও আমন ধান ওঠার আগে ভূমিহীন-প্রান্তিক কৃষকদের হাতে কাজ থাকে না। 

কাজের খোঁজে ছুটছেন কৃষি শ্রমজীবীরা। সম্প্রতি রংপুরের মর্ডান মোড়েছবি: প্রথম আলো

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অনন্তরাম গ্রামের কৃষক আইয়ুব সরকার এবার ধারদেনা করে বোরো ধানের চাষ করেছেন। বাকিতে সার ও কীটনাশক কিনেছেন। তারপরও চলতে পারছেন না। এখন তিনি ভাবছেন, কোনো কাজ করতে অন্য এলাকায় যাবেন।

আইয়ুব সব মিলিয়ে ৭৭ শতাংশ জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। এর মধ্যে নিজের ৩৩ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ বন্ধক নিয়েছেন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ৫ থেকে ৪৯ শতাংশ জমির মালিক প্রান্তিক কৃষক। তবে আইয়ুব বলছেন, তিনি একজন কৃষি শ্রমিকও।

পীরগাছা সদর ইউনিয়নের ৩ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে দশগাঁও বাজার। গত ১৭ এপ্রিল দুপুরে এখানে কৃষক আইয়ুব, মশিউর রহমান ও হামিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তখন বাড়িলাগোয়া একটি চা-পানের দোকান দেখিয়ে আইয়ুব বলেন, এটি তাঁর। দোকান থাকার পরও তিনি চলতে পারছেন না।

আইয়ুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি, আমার পরিবার (স্ত্রী) আর একটা ব্যাটা খাই। ঘরে ভাত নাই (ধান বা চাল মজুত নেই)। ঢাকা-কুমিল্লা না গেলে সংসার চলবে না।’

এই অবস্থা শুধু আইয়ুব সরকারের নয়। গত দুই সপ্তাহে রংপুরের পীরগাছা, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, ভূমিহীন, প্রান্তিক কৃষক ও কৃষি শ্রমিকেরা কাজের খোঁজে বাড়ি ছেড়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগ ধান কাটার কাজ করতে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীতে গেছেন।

রংপুরের কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। তবে ফসল ওঠার আগে, বিশেষ করে বোরো ও আমন ধান ওঠার আগে ভূমিহীন-প্রান্তিক কৃষকদের হাতে কাজ থাকে না। এতে তাঁদের দারিদ্র্য বাড়ে। অর্থনীতিবিদেরা একে বলেন ‘মৌসুমি দারিদ্র্য’।

সরেজমিন চিত্র

পীরগাছার দশগাঁও বাজার থেকে পূর্বদিকে কোনাপাড়া গ্রাম। এই গ্রামের রবিউল, আবদুর রশিদ, রুহুল আমিন, সাইফুল ও আমজাদ ধান কাটতে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে গেছেন ১৩ এপ্রিল।

রবিউল ও রশিদ দুই ভাই। ১৭ এপ্রিল তাঁদের বাড়িতে গেলে রবিউলের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম বলেন, চৈত্র মাস থেকে তাঁর স্বামীর কাজ নেই। একটি এনজিও থেকে তাঁরা ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ১০০ টাকা কিস্তি দিতে হয়। দুই হাজার টাকা ধার করে তাঁর স্বামী বাইরে কাজ করতে গেছেন। টাকা পাঠালে তিনি কিস্তি দেবেন। সংসারেও খরচ করবেন।

স্থানীয় লোকজনসহ অন্তত ৫০টি কৃষি শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে ঈদের পরদিন থেকে রংপুরের মডার্ন মোড় থেকে বাসে করে শত শত শ্রমিক ব্যাগ-বাউঙ্কাসহ কুমিল্লা, নোয়াখালীতে যাচ্ছেন।

গত সপ্তাহে মডার্ন মোড়ে গিয়ে দেখা যায় যে সন্ধ্যা হলেই পীরগাছা, পাওটানা, কাউনিয়া, কুর্শা, দমদমা, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকা থেকে সেখানে কৃষি শ্রমজীবীরা আসছেন। তাঁরা কেউ বয়স্ক, কেউ তরুণ। তাঁদের কারও হাতে ব্যাগ, কারও পিঠে। সঙ্গে ধান কাটার কাঁচি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, লক্করঝক্কর বাসে করে কৃষিশ্রমিকেরা গন্তব্যে যাচ্ছেন। বদরগঞ্জের দক্ষিণ ওসমানপুরের ফরজাহান আলী (৬৫) বলেন, তিনি গত বছর ৮০০ টাকা ভাড়া দিয়ে কুমিল্লায় গিয়েছিলেন। তবে এ বছর ভাড়া দ্বিগুণ।

কৃষি শ্রমজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে ধান কাটার কাজ করলে দিনে মজুরি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পাওয়া যায়।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, রংপুরে এ বছর ১ লাখ ৩১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ধান কাটার ভরা মৌসুম শুরু হবে আরও ১৫-২০ দিন পর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এনামুল হকের দাবি, আড়াই থেকে তিন মাস আগে আলু ওঠানো ও বোরো রোপণে কৃষি শ্রমজীবীরা ব্যস্ত ছিলেন। জীবনকাল কম, এমন উফশী জাতের ধান কাটা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। জেলায় তেমন কাজের সংকট নেই।

রংপুর থেকে ঠিক কতসংখ্যক শ্রমজীবী ফসল ওঠার আগে বাইরে কাজে যান, তার তথ্য জেলা প্রশাসন, আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ে ঘুরে জানা যায়নি। তবে ২০১৯ সালের কৃষিশুমারি তথ্য বলছে, জেলায় কৃষিমজুর খানার সংখ্যা ২ লাখ ৮২ হাজার ১৭৯টি। অর্থাৎ এসব খানার সদস্যরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রংপুরে খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকে। জেলার মোট আবাদি জমির ৪০ শতাংশ দ্বিফসলি। ৪৬ শতাংশ জমি তিনফসলি। ফলে কৃষি শ্রমিকেরা আগের তুলনায় ব্যস্ত থাকেন। তবে কিছুসংখ্যক কৃষি শ্রমিক বাড়তি আয়ের জন্য অন্যত্র যাচ্ছেন।

জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি ও রংপুর সদরের গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ চাপে আছে। সংসার টেকানোর তাগিদে কৃষি শ্রমিকেরা বাইরে যাচ্ছেন। তাঁর ইউনিয়ন থেকে এবার অন্তত এক হাজার কৃষি শ্রমিক বাইরে গেছেন।

সার্বিক বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোরশেদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রংপুর বিভাগের মানুষ আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। রংপুরে এত দিনেও শিল্পায়ন হয়নি। এখানে কাজের সুযোগ কম। তাই শ্রমজীবীরা অন্য এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে দ্রুত শিল্পায়ন করা না হলে রংপুরে কাজের সংকট আরও বাড়বে।