নারায়ণগঞ্জ জেলার মানচিত্র

মুঠোফোনে ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্তি ছিল কিশোরটি। আসক্তির কারণে সপ্তম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। এতে মা–বাবা তাকে বকাঝকা ও চাপ দেন। এ কারণে অভিমান করে ঘর ছেড়ে চলে যায় ওই কিশোর। এরপর গত ১১ মাস পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না তার।

ছেলের খোঁজে মা বিউটি বেগম নারায়ণগঞ্জের আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। তাদের সহায়তায় গতকাল বৃহস্পতিবার আরিফ হোসেন ওরফে রিয়াদ (১৪) নামের ওই কিশোরকে সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়।

ওই কিশোরের পরিবার থাকে নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুর ব্রাঞ্চ রোড এলাকার একটি ভাড়া টিনশেড বাড়িতে। আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় সেখানে কথা হয় কিশোর আরিফ হোসেন, তার মা গৃহিণী বিউটি বেগম এবং বাবা চটপটি বিক্রেতা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে।

মা–বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সে আনোয়ার-বিউটি দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ছেলে আল আমিন বান্দরবানে কোয়ান্টাম স্কুল অ্যান্ড কলেজে এইচএসসি ভোকেশনালে পড়াশোনা করছে। ৯ বছর বয়সী ছোট ছেলে হজরত আলী একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে পড়াশোনা করছে। আরিফ নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুর বার একাডেমি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত।

বিউটি বেগম জানান, আরিফ ছাত্র হিসেবে ভালো ছিল। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তাঁর রোল নম্বর ১ ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তাকে একাডেমি স্কুলে ভর্তি করা হয়। এর পর থেকে আরিফ মুঠোফোনে ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। মুঠোফোনে গেম খেলার সুবাদে সে প্রতিবেশী শরীফ হোসেনের বাসায় আসা-যাওয়া করত। তার মুঠোফোনে ফ্রি ফায়ার গেম খেলত। সপ্তম শ্রেণি প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় তার ফল খারাপ হয়।

বিউটি বেগম বলেন, পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় তিনি ছেলেকে বকাঝকা করেন। ভালোভাবে পড়াশোনা করার জন্য চাপ দিতেন। বাসায় গেম খেলা বন্ধ করে দেন। এ কারণে তাঁর ছেলে গত বছরের ১৮ জুলাই ঘর থেকে দুটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন, ইন্টারনেট ব্যবহারের রাউটার ও সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে চলে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাওয়া পাচ্ছিল না। পরে গত বছরের ১০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতিবেশী নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শরীফ হোসেন, তার বাবা হানিফ মিয়া ও মা শাহিদা বেগমকে আসামি করে মামলা করেন।

আদালতের নির্দেশে সিআইডির তৎপরতায় ১১ মাস পর ছেলেকে ফিরে পাওয়া বিউটি বেগম বলেন, ‘ছেলেকে কে নিয়ে গেল, এত দিন কোথায় ছিল, কার কাছে ছিল—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইনি। সিআইডিও আমাদের কিছু জানায়নি। ছেলের এমন কাণ্ডে হতবাক আমরা। সে যদি আবার চলে যায়, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

তবে কিশোর আরিফ হোসেন জানায়, বেশি দুষ্টুমি করার কারণে মা তাকে মারধর করত। এ কারণে সে রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ডে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিল। সেখানে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওই ব্যক্তি তাকে টাঙ্গাইল নিয়ে যান। সেখানে ওই ব্যক্তি তাঁর মুদিদোকান ও মুঠোফোন মেরামতের দোকানে কাজ দেন। ছয় মাস পর ওই ব্যক্তি মারা গেলে তাকে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে একটি হোটেলের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই হোটেল বয়ের কাজ করত, থাকত। তবে ওই ব্যক্তির নাম ও কোন হোটেলে ছিল, তা বলতে পারেনি আরিফ।

আরিফ বলে, ‘আমি ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে পছন্দ করতাম। প্রতিবেশী শরীফ ভাইয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। তাদের বাসায় মাঝেমধ্যে গেম খেলতে যেতাম। তবে কেউ ফুসলিয়ে আমাকে নিয়ে যায়নি। অনেক দিন পর ফেসবুক মেসেঞ্জার খুলে দেখি, শরীফ ভাই ঝামেলা হচ্ছে জানিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসার কথা বলে। তখন আমার মোবাইলে সিআইডি ফোন দেয়। এরপর সিলেট থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি।’

আরিফের গেম খেলার আসক্তির কথা জানান তার বাবা আনোয়ার হোসেনও। তিনি বলেন, ছেলের সঙ্গে তাঁর খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। ছেলে যখন যেটা চাইত, সাধ্য অনুযায়ী এনে দিতেন। ছেলের এমন কাণ্ডে আনোয়ার কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের জন্য আমরা মানসিকভাবে খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছি। ছেলের স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। ছেলের ব্রেন ওয়াশ করা হয়েছে। এ কারণেই কারও প্ররোচনায় এমন কাজ করেছে।’

এ বিষয়ে সিআইডি নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর আরিফ তার মায়ের সঙ্গে রাগ করে বাসা থেকে চলে গিয়েছিল। প্রথমে সে এক ব্যক্তির সঙ্গে টাঙ্গাইল চলে যায়। সেখানে ওই ব্যক্তিকে এতিম পরিচয় দেয়। পরে ওই ব্যক্তির মুদিদোকান ও মুঠোফোন সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজ করত। ওই ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর আত্মীয়স্বজন আরিফকে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে একটি হোটেলে কাজে লাগিয়ে দেয়। তবে ওই ব্যক্তির নাম জানে না আরিফ।

সিআইডির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রযুক্তির সহায়তায় আরিফের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। পরে চাপ দিয়ে তাকে নারায়ণগঞ্জে আনা হয়। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আরিফ সব বলেছে। দুষ্টুমি করার কারণে মা তাকে মারধর করেন। এ কারণে সে বাসা থেকে চলে গিয়েছিল।