সুন্দরভাবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাস করার জন্য মাদারীপুরের বিভিন্ন উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একতলা ভবন নির্মাণ করে দিয়েছিল সরকার। কয়েক বছর যেতে না যেতেই এর মধ্যে বেশ কিছু ভবনের দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে। বেশ কিছু ঘরের ছাদ চুইয়ে ভেতরে পানি পড়ছে। এতে এসব ভবনে বসবাস করতে সমস্যা হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের।
ঘর পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর সদস্য এবং স্থানীয় কয়েকজন বলেন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী, উপকরণ এবং পুরোনো জানালা এবং গ্রিল ব্যবহার করায় ঘরগুলো এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা ঘরগুলো সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে এলজিইডি মাদারীপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব ঘর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি। অন্য দপ্তর থেকেও সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেই। ঘরগুলো জরাজীর্ণ হওয়ার জন্য ঠিকাদারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এত কম বরাদ্দে ভালো মানের বীর নিবাস তৈরি করা যায় না। এ কারণে এলজিইডি আপাতত এই প্রকল্পে কাজ করছে না। এখন যে বীর নিবাসগুলো হচ্ছে, সেগুলো অন্য দপ্তর থেকে করা হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসন ও এলজিইডির সূত্র জানায়, অসহায় ও অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী (এলজিইডি) বিভাগ মাদারীপুর জেলা ৩৭টি বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য ভবন নির্মাণ করে। এ ভবনগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে বীর নিবাস। প্রতিটি বীর নিবাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১০টি, রাজৈরে ৭টি, কালকিনিতে ১২টি এবং শিবচর উপজেলায় ৮টি বীর নিবাস রয়েছে। ১১ জন ঠিকাদার ভবনগুলো নির্মাণ করেছেন। প্রতিটি বীর নিবাস প্রায় ৯০০ বর্গফুট। এর মধ্যে দুটি কক্ষ, একটি ড্রয়িংরুম, রান্নাঘর, একটি গোয়ালঘর, শৌচাগার ও নলকূপ রয়েছে।
মাদারীপুর সদর উপজেলার রাস্তি ইউনিয়নের লক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা শাহানা বেগম (৬০)। তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রব চৌধুরী দুই যুগ আগে মারা গেছেন। অসচ্ছল এই পরিবারের জন্য ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একতলা একটি ঘর উপহার পেয়েছিলেন। ঘরের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল শৌচাগার, নলকূপ।
অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে দেওয়া বীর নিবাসটি এখন জরাজীর্ণ। পরিবার নিয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তবু শাহানা বেগম তাঁর এক ছেলেকে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই বীর নিবাসে আট বছর ধরে বাস করছেন। সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার আবেদন করেও কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি।
শাহানা বেগম ছাড়াও মাদারীপুর সদর উপজেলার আরও ৯টি বীর নিবাস এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়েছে। এসব বাড়ির একাধিক স্থানে ফাটল ধরে প্রবেশ করছে বৃষ্টির পানি। খসে পড়ছে পলেস্তারা। অকেজো হয়ে গেছে শৌচাগার এবং নলকূপটিও।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, বরগুনা সদর উজেলায় ৩৭টি বীর নিবাস নির্মাণ করে ১১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে মেসার্স মেহেদী এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মীর জসিম, মেসার্স মমতাজ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স নূসাব এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সালেহা কনস্ট্রাকশন, মেসার্স বাবুল এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স খোকন বেপারী, মেসার্স দবির অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স আবু জিয়াদ ট্রেডার্স ও মেসার্স শিপাই এন্টারপ্রাইজ। বীর নিবাস নির্মাণে কাজ পাওয়া এসব ঠিকাদারের বেশির ভাগই শরীয়তপুরের। বীর নিবাস নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁদের মধ্যে তিনজন ঠিকাদার বলেন, ‘যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাতে এর চেয়ে ভালো ঘর বানানো সম্ভব নয়। তাঁরা ভালোভাবে ঘর নির্মাণের চেষ্টা করছেন।’
মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচটি বীর নিবাস ঘুরে দেখা যায়, ভবনগুলোর বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। বৃষ্টি হলে দেয়াল ও ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে ঘরের বিছানা ও আসবাব নষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি বাড়ির মেঝে ভেঙে খোয়া বের হয়ে গেছে। ছাদে ফাটল দেখা দেওয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কের মধ্যে বীর নিবাসগুলোয় ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।
উপহারের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঠকানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার জাহাঙ্গীর কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের মহৎ উদ্যোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বীর নিবাস প্রকল্প। কিন্তু এ প্রকল্পে ঠিকদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতি থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতারিত হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বীর নিবাসগুলো সংস্কারের জন্য আমাদের কাছে কয়েকজন আবেদন করেছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে এই প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলব। চেষ্টা করব বাজেট বরাদ্দ করে ঘরগুলো মেরামত করার।’