‘বৃত্তির ক্লাস করার জন্য ছেলে স্কুলে ছিল, অহন বৃত্তি কে দিব’
‘কয়েক দিন পর স্কুলের অ্যানুয়াল প্রোগ্রাম হবে। স্যাররা সিলেক্ট করছে। ওরে দিয়্যা উপস্থাপনা করাবে। এ জন্য ছেলে বলছিল, আমাকে ব্লেজার বানিয়ে দিতে হবে। হেই ব্লেজার আর বানানো হলো না। এখন স্কুলের অনুষ্ঠানেও থাকব না।’ এভাবে প্রলাপ বকতে বকতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নের নগর ভাতগ্রাম নয়াপাড়ার লিপি বেগম।
লিপি বেগম ও রুবেল মিয়ার ছেলে তানভীর হোসেন (১৩) রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। গতকাল সোমবার দুপুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে গেলে নিহত হয় তানভীর। তানভীরের বাবা রুবেল মিয়া ১০ বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকার উত্তরায় বসবাস করেন। তিনি ব্যবসা করেন।
আজ মঙ্গলবার সকালে তানভীরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ভিড় করছেন তাঁর বাড়িতে। নারী, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষ সেখানে উপস্থিত। ঢাকা মেডিকেলের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে মরদেহ হস্তান্তরের পর আজ ভোরে লাশ গ্রামে আনা হয়।
বাড়িতে একনাগাড়ে কাঁদছেন লিপি বেগম। মাঝে মাঝে প্রলাপ বকছেন। তিনি বলেন, ‘ওরে স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি করা হয়। ক্লাসে সব সময়ই ফার্স্ট হইছে। ও নোট লেখছে, স্যারেরা সেই নোট অন্য ছাত্রদের পড়াইছে। কোনোদিন ক্লাস মিস দেয় নাই। ঝড় থাক, বৃষ্টি থাক, ছাতা নিয়া ক্লাসে গেছে। ভালো ছাত্র দেইখা স্যারেরা এইটে বৃত্তির জন্য সিলেক্ট করছিল। বৃত্তির ক্লাস করার জন্য ছেলে স্কুলে ছিল। এর আগেই আমার ছোট ছেলেকে (তাসরিফ আহমেদ, একই প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী) ক্লাস শেষে বাসায় আনা হয়। অহন বৃত্তি কে দিব! বড় ছেলে সীমান্ত ২০০৭ সালে মারা যাওয়ার পাঁচ বছর পর তানভীর হইছে। কত শখ করত আইইএলটিএস করে দেশের বাইরে যাবে। হের আগেই ও আমাকে ছেড়ে চইল্যা গেল।’
তানভীরকে খুব আদর করতেন তাঁর ফুফু জোলেখা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমরা টিভিতে খবর পাই স্কুলে বিমান পড়ছে। পরে হুনি ও মারা গেছে। পোলাডায় ঢাকা থেকে বাড়ি আইলেই আমার বাড়িতে গিয়া হুয়া থাকত। খিদা লাগলেই বলত, ফুফু ভাত দ্যাও। আমি ওরে ভুলা হারি না।’
তানভীরের চাচাতো ভাই সজীব হোসেন বলেন, সোমবার রাতে ঢাকা থেকে মরদেহ নিয়ে গ্রামের পথে আসার সময় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মৌচাক এলাকায় তানভীরকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স সড়ক বিভাজকে উঠে উল্টে যায়। এতে তাঁর চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলামের হাত ভেঙে যায়। তিনি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সে তানভীরের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়।
আজ সকাল ১০টায় পার্শ্ববর্তী আন্দিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে তানভীরের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাঁকে আন্দিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম আরিফুল ইসলাম, উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির ইয়াই ইয়া খান মারুফ, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডিএম শফিকুল ইসলামসহ গ্রামের হাজারো মানুষ।
ইউএনও বলেন, ‘আমরা তো সন্তানদের স্কুলে পাঠাই। অপেক্ষায় থাকি সন্তানদের ফিরে আসার। সেখান থেকে যখন সন্তান আর বাসায় ফেরে না, তখন মা–বাবা কীভাবে নেয়, তা বলার কোনো ভাষা থাকে না। তানভীরের বেলায়ও তাই হয়েছে। প্রশাসন তানভীরের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে।’