কেউ আখ কাটতে ব্যস্ত, কেউ ব্যস্ত আখ থেকে পাতা ছাড়ানোয়। অনেকে সেই আখ গরুর গাড়ি কিংবা ভ্যানগাড়িতে করছেন আনা–নেওয়ার কাজ। অন্যদিকে যন্ত্রে ঢুকিয়ে আখ থেকে রস তৈরি, উনুনে (চুল্লি) রস চাপানো, ঘন রস সংরক্ষণ, ছোবড়া শুকানো চলছে পুরোদমে। আখমাড়াই এবং গুড় তৈরির এ মহোৎসব এখন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে।
গত বুধবার উপজেলার সিংহশ্রী ও রায়েদ ইউনিয়ন ঘুরে গুড় তৈরির কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ে। গ্রামের রাস্তায় চলতে চলতে দেখা যায় আখভর্তি ভ্যানগাড়ি ও গরুর গাড়ি।
সড়কের পাশে আখখেতের কোনায় মাড়াইযন্ত্র, বড় কড়াই বসানোর চুল্লি, আখের ছোবড়া শুকানোর জায়গা। চুল্লিতে রাত–দিন চলে গুড় তৈরির কাজ। চুল্লির পাশেই উৎপাদিত গুড় জমা করে রাখা হয়। পাইকাররা এসে গুড় কিনে নিয়ে যান বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিষ্টতা, স্বাদে কাপাসিয়ার আখের খ্যাতি ও চাহিদা দেশজোড়া।
কাপাসিয়ার কৃষি কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, কাপাসিয়া অঞ্চলের মাটি আখ চাষের জন্য উপযোগী। এ উপজেলায় ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ২১, ঈশ্বরদী ২/৫৪, টেনাই, অমিত জাতের আখ চাষ হয়। এগুলোর মধ্যে ঈশ্বরদী ১৬ সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। গত বছর কাপাসিয়ায় প্রায় ১ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়েছিল। চলতি বছরের আখ চাষের হিসাব হবে মাড়াই শেষে।
কাপাসিয়ার আখ ও গুড় দুটোরই ব্যাপক চাহিদা। এ অঞ্চলের কিছু বিশেষ জাতের আখ চিবিয়ে খাওয়ার জন্য জনপ্রিয়।
সিংহশ্রী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া গ্রামে আখমাড়াই যন্ত্র বসিয়েছেন মজিবুর রহমান। সেখানে মাসখানেক ধরে আখমাড়াই চলছে। বড় উনুনে (চুল্লি) আখের রস জাল দিতে দিতে মজিবুর এই প্রতিবেদককে জানান, আরও তিন থেকে চার মাস জ্বলবে তাঁর চুল্লি। এই মৌসুমে এক কোটি টাকার বেশি গুড় বিক্রি করার আশা তাঁর।
মজিবুর বলেন, ২০০০ সাল থেকে তাঁর গুড় তৈরির ব্যবসা। প্রতিবছর কয়েক হেক্টর জমির আখ আগাম কিনে রাখেন। পরে নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলো থেকে গুড় উৎপাদন করেন। একেক মৌসুমে গুড় উৎপাদনে তাঁর সঙ্গে কর্মসংস্থান হয় আরও অন্তত ৮ থেকে ১০ জনের।
রায়েদ ইউনিয়নের আমরাইদ গ্রামের কৃষক জহিরুল ইসলাম আখমাড়াইয়ের জন্য প্রতিবছর তাঁর জমিতে যন্ত্র বসান। আগে গরু বা মহিষ দিয়ে আখমাড়াই করা হতো। কিন্তু এখন আধুনিক মেশিনের ব্যবহারে গতি এসেছে। জহিরুল বলেন, আগে কাপাসিয়ায় প্রচুর আখ চাষ হতো, বর্তমানে এর পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। তবে আখ থেকে গুড় তৈরিতে লাভ বেড়েছে।
আখমাড়াইয়ে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আখের রস জ্বাল দেওয়ার পর তা ঘন হয়ে উঠলে টিনের তৈরি ড্রামের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। উত্তাপ কমে এলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে গুড় জমাট বাঁধে। এ ছাড়া আখের রশিও (তরল গুড়) বাজারে বিক্রি হয়। তরল গুড় আলাদা বোতলে সংরক্ষণ করা হয় বাজারজাতের উদ্দেশ্যে।
আখের মান ভালো হলে প্রতি খোলা (গুড় জ্বাল দেওয়ার কড়াই) থেকে ৪০-৫০ কেজির মতো গুড় পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার-পাঁচটি গুড়ের খোলা ওঠানো সম্ভব হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি গুড় খুচরা ১২০ টাকা ও পাইকারি ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বেশ লাভও হচ্ছে।
কাপাসিয়া উপজেলা উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর আগের বছরগুলোর তুলনায় আখ চাষ কিছুটা কম হয়েছে।
অনেক কৃষক অন্যান্য ফসল উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন। আবার নতুন করেও অনেকে আসছেন। কাপাসিয়ার আখ ও গুড় দুটোরই ব্যাপক চাহিদা। অঞ্চলের কিছু বিশেষ জাতের আখ চিবিয়ে খাওয়ার জন্য জনপ্রিয়। সার্বিকভাবে আখ থেকে গুড় তৈরি করলে সেটি অনেক বেশি লাভজনক হয়।