‘জীবনে এক আছিল, মরণেও একলগে গেল’

ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সাত প্রবাসীর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তাঁরা সবাই ওমানে মাছ ধরার পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বপ্ন ছিল পরিবারে সচ্ছলতা আনা। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে তাঁদের স্বপ্নেরও।

ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ওপরে বাঁ থেকে মো. জুয়েল, আমিন মাঝি ও মো. সাহাবুদ্দিন। নিচে বাঁ থেকে মো. রনি, মো .বাবলু ও মো. রকিছবি: পরিবারের সৌজন্যে

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের সারিকাইত গ্রামের পাকা মসজিদ গলি দিয়ে সাগরপারের রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোতেই চোখে পড়ে সরু রাস্তার দুই পাশে দুটি ঘর। জীর্ণ ঘরগুলোর একটি প্রবাসী সাহাবুদ্দিনের, অন্যটি বাবলুর। ঘরগুলোর সামনে কয়েক শ মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই প্রবাসী বাবলুর ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ঘরে উঁকি দিতেই চোখে পড়ে, মেঝেতে পড়ে বিলাপ করছেন এক নারী।

লোকজনকে প্রশ্ন করে জানা গেল, তিনি বাবলুর মা জোসনে আরা বেগম। বিলাপ করে বারবার ছেলের কথা বলছিলেন। ক্ষণে ক্ষণে ছেলের বন্ধু সাহাবুদ্দিনকে ডাকছিলেন। বিলাপের সুরে জোসনে আরা বলছিলেন, ‘জীবনে তারা এক লগে আছিল, মরণেও তারা একলগে গেল।’

আজ বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় সারিকাইত গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। শোকে হতবিহ্বল গ্রামবাসী একসঙ্গে এতগুলো তরতাজা যুবকের মৃত্যু মানতে পারছেন না।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ সময় বিকেলে চারটায় ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সাত প্রবাসী নিহত হন। এর মধ্যে সারিকাইত ইউনিয়নের বাসিন্দাই পাঁচজন। এ ছাড়া মাইটভাঙার একজন ও রহমতপুর ইউনিয়নের একজন বাসিন্দা আছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাগরে মাছ শিকার শেষে বাড়ি ফেরার পথে ওমানের ধুকুম সিদ্দা এলাকায় প্রবাসীদের বহন করা গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন সারিকাইতের আমিন মাঝি, মো. আরজু, মো. রকি, সাহাব উদ্দিন ও মো. বাবলু এবং মাইটভাঙার মো. জুয়েল ও রহমতপুরের মো. রনি।

সাহাবুদ্দিন আর বাবলু ছিল অভিন্ন হৃদয়। বিদ্যালয়ে যাওয়া, বেড়ে ওঠা সবই একসঙ্গে। একসঙ্গে দুই বন্ধু দেশে এসেছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর একই ফ্লাইটে  তাঁরা ওমানে ফিরে গেছেন। বুধবারের দুর্ঘটনাও তাঁদের আলাদা করতে পারেনি। ঘটনার দিন বাবলুর মা জোসনে আরা ছিলেন চট্টগ্রামে। গতকাল বিকেল পাঁচটায় প্রথমে তিনি ছেলের দুর্ঘটনার কথা শুনলেও মৃত্যুর খবর জানতেন না। পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর ছেলে আর বেঁচে নেই। বাবলুর তিন বছরের ছেলে আর দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। জোসনে আরা তাদের কী বলে সান্ত্বনা দেবেন জানেন না।

সারিকাইত ইউনিয়নের নিহত পাঁচ প্রবাসীর সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। স্বপ্ন দেখেছিলেন বিদেশে রোজগার করে আবার একসঙ্গে দেশে ফিরবেন তাঁরা। সংসারে ফিরবে সচ্ছলতা। কিন্তু সেই স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়েছে। আজ সকালে সারিকাইতের শিবের হাটের দক্ষিণে পাকা মসজিদ এলাকায় পৌঁছালে এলাকাবাসীর শোক টের পাওয়া যায়। পাকা মসজিদ থেকে সাগরপারের দিকে একই রাস্তায় দুর্ঘটনায় নিহত চারজনের বাড়ি।

ঘরের মেঝেতে বসে বিলাপ করছিলেন সাহাবুদ্দিনের মা নাজমা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

এলাকার লোকজন জানালেন, জন্মের পর থেকে সাগরপারেই একসঙ্গে বেড়ে ওঠা চারজনের। মৃত্যুও হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের ধুকুম এলাকার সাগরপারে। একজন ছাড়া নিহত প্রবাসীরা সবাই বয়সে তরুণ। চার বছরের নিচে এক বা একাধিক সন্তান রয়েছে তাঁদের। তাঁদের চেয়ে বয়সে বড় আমিন মাঝি (৫০) এবার দেশে ফিরে মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন। সেই মেয়েটি এখন বাবার শোকে কাতর।

সাহাবুদ্দিন আর বাবলু ছিল অভিন্ন হৃদয়। বিদ্যালয়ে যাওয়া, বেড়ে ওঠা সবই একসঙ্গে। একসঙ্গে দুই বন্ধু দেশে এসেছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর একই ফ্লাইটে তাঁরা ওমানে ফিরে গেছেন তাঁরা। বুধবারের দুর্ঘটনাও তাঁদের আলাদা করতে পারেনি। ঘটনার দিন বাবলুর মা জোসনে আরা ছিলেন চট্টগ্রামে। গতকাল বিকেল পাঁচটায় প্রথমে তিনি ছেলের দুর্ঘটনার কথা শুনলেও মৃত্যুর খবর জানতেন না। পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর ছেলে আর বেঁচে নেই। বাবলুর তিন বছরের ছেলে আর দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। জোসনে আরা তাদের কী বলে সান্ত্বনা দেবেন জানেন না।

এলাকার লোকজন জানালেন, জন্মের পর থেকে সাগরপারেই একসঙ্গে বেড়ে ওঠা চারজনের। মৃত্যুও হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের ধুকুম এলাকার সাগরপারে। একজন ছাড়া নিহত প্রবাসীরা সবাই বয়সে তরুণ। চার বছরের নিচে এক বা একাধিক সন্তান রয়েছে তাঁদের। তাঁদের চেয়ে বয়সে বড় আমিন মাঝি (৫০) এবার দেশে ফিরে মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন। সেই মেয়েটি এখন বাবার শোকে কাতর।

আবার কথা হবে

বাবলুর ঘর থেকে বেরিয়ে সাহাবুদ্দিনের ঘরে যেতেই স্বজনদের বিলাপের শব্দ শোনা যায়। টিনের ঘরের বারান্দার একটি চৌকিতে শুয়ে ছিলেন বাবা মো. সিদ্দিক। তিনি জানান, ছেলে গতকাল দুপুরেই ভিডিও কলে কথা বলেছে। চার মাস বয়সী মেয়েকে প্রাণভরে দেখেছে। কথা দিয়েছে, সাগর থেকে ফিরেই আবার ভিডিও কল দেবে। কিন্তু সেই ভিডিও কল এই জীবনে আর আসবে না। পাশেই ঘরের মাটির মেঝেতে দুই হাত ওপরে তুলে ফরিয়াদ করছিলেন সাহাবুদ্দিনের মা নাজমা বেগম। তিনি বারবার একটা কথাই বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমার ছেলেকে, আমার গলার মালাকে এনে দাও। আমি তাকে ফেরত চাই।’

বাবলু আর সাহাবুদ্দিনের বাড়ি পেছনে ফেলে গাছতলী বেড়িবাঁধ থেকে কিছুটা দক্ষিণেই গেলেই প্রবাসী রকির বাড়ি। রকির বাবা ইব্রাহীমও পরিবার নিয়ে থাকেন সেখানে। রকির রয়েছে চার মাস বয়সী ছেলে নূর ইয়ামীন। রকির বাবা ইব্রাহীম বলেন, সাগরে রওনা হওয়ার আগে রকি ভিডিও কলে অনেকক্ষণ কথা বলেছে ছেলে ইয়ামীনের সঙ্গে। চার মাসের ইয়ামীন কিছুই বোঝে না, কেবল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে।

প্রবাসী আরজুর বাবার প্রশ্ন, তিন বছরের আনিসা এখন কাকে বাবা বলে ডাকবে
ছবি: প্রথম আলো

স্বপ্ন পূরণ হলো না

১৭ বছর ধরে বিদেশে আছেন আমিন মাঝি। এবার দেশে আসার কথা ছিল তাঁর। বাড়ি এলে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের স্বপ্ন ছিল আমিনের। আমিনের ছোট ভাই আকবর (৪০) জানান, তাঁর ভাইদের বহন করা মিনিবাসকে দ্রুতগতির একটি লরি ধাক্কা দেয়। এতে মিনিবাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়।

আকবর আরও জানান, নিহত প্রবাসীদের সবাই আমিন মাঝির অধীন কাজ করতেন। তাঁরা একই বাসায় থাকতেন। ধুকুম এলাকায় ওমান সাগরে মাছ শিকার করতেন তাঁরা।

সারিকাইত ৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রবাসী মো. আরজুর (২৮) বাড়ির রাস্তা ধরে এগোতেই বহু দূর থেকে কানে ভেসে আসে স্বজনদের বিলাপের শব্দ। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই বাতাস ভারী করা আর্তনাদের শব্দ জোরালো হয়। বাবা শহীদুল্লাহ ঘরের বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে ‘আনিসা কারে বাপ ডাকবে’ বলে বিলাপ করছিলেন। আনিসা আরজুর তিন বছর বয়সী একমাত্র সন্তান। শহীদুল্লাহ জানান, তাঁর ছেলে চার বছর আগে বিয়ে করেন, আছে তিন বছরের মেয়ে আনিসা। প্রথমবারের মতো বিদেশ গিয়েছিল আরজু। স্বপ্ন ছিল পরিবারের অভাব দূর করার। সে কারণেই ঝুঁকি নিয়ে মাছ মারার বোটে চাকরি নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন।