প্রবারণার আমেজ নেই রামেসু এলাকায়

পুড়ে যাওয়া একটি ঘরে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছেন এক বাসিন্দা। গত শনিবার খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজারেছবি: প্রথম আলো

বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রবারণা পূর্ণিমা মানে আনন্দ, মিলন আর উৎসবের দিন। বছরের এই দিনে পাহাড়ের বিহারগুলো সাজে রঙিন আলোকসজ্জায়, নদীতে ভাসে কল্পজাহাজ, ঘরে ঘরে রান্না হয় পায়েস, পিঠা ও নানা মুখরোচক খাবার। ছোট-বড় সবাই পরে নতুন জামা। বিশেষ করে মারমা সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই উৎসব উদ্‌যাপন করেন সবচেয়ে জাঁকজমকভাবে। তবে এবার উৎসবের আমেজ নেই খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু এলাকায়।

সম্প্রতি রামেসু বাজার এলাকায় গুলিতে তিন পাহাড়ির মৃত্যু হয়। এ ছাড়া সহিংসতার আগুনে পুড়ছে রামেসু বাজার এলাকার প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টির মতো দোকান। এখনো পুড়ে যাওয়া অনেক স্থাপনার ধ্বংসস্তূপ সরানো হয়নি।

গত শনিবার বিকেলে রামেসু বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় বিহারটি একেবারে নিস্তব্ধ। বিহারের দেয়ালেও নেই কোনো আলোকসজ্জা। পাড়াগুলোতে কোনো প্রবারণা উদ্‌যাপনের কোনো প্রস্তুতি নেই। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে এ সময় কথা হয়। তাঁরা বলেন, প্রতিবছর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাহাড়িরা প্রবারণার আগে বিহার পরিষ্কার করেন, ফানুস বানান। এবার এলাকায় উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। বিহারে কেবল নিয়ম রক্ষার আয়োজন রয়েছে।

সবাই জান বাঁচাতে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছি। এমন অবস্থায় আছি, মনে হয় প্রবারণা পূর্ণিমার আনন্দ আর কখনো আমাদের জীবনে আসবে না।
অংসুই মারমা, রামেসু এলাকার বাসিন্দা

স্থানীয় মারমা নারী নু মারমা বলেন, বিগত বছরগুলোতে প্রবারণার আগে থেকেই সেলাইয়ের দোকানগুলোতে নতুন জামা বানানোর ব্যস্ততা দেখা যেত। এবার সেই চিত্র নেই। বাজারে চারটি দোকান ছাড়া সব পুড়ে গেছে।

অংসুই মারমা নামের আরেকজন বলেন, ‘এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। কারও বাড়িতে গোসল করি, কারও বাড়িতে খাই। জীবনটা কেমন যেন থেমে গেছে। আমাদের তিন ভাই–বোনের পাকা আর আধা পাকা তিনটি বাড়ি ছিল। সবার বাড়ি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজনের বাড়িও যদি অক্ষত থাকত মনে শান্তি পেতাম।’ তিনি বলেন, ‘সবাই জান বাঁচাতে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছি। এমন অবস্থায় আছি, মনে হয় প্রবারণা পূর্ণিমার আনন্দ আর কখনো আমাদের জীবনে আসবে না।’

পুড়ে যাওয়া একটি ঘর। গত শনিবার রামেসু এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রামেসু এলাকার কিশোরী ইখেংচি মারমা জানান, প্রতিবছর প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে দুই সেট পোশাক তাকে কিনে দেওয়া হতো। এ বছরও কিনে দিয়েছে তার মা। প্রতিবছর বান্ধবীদের সঙ্গে নতুন কাপড় পরে বিহারে গেলেও এবার একইভাবে যাওয়া হবে না। বান্ধবীদের অনেকের ঘর পুড়ে যাওয়ায় তারা নানাজন নানা জায়গায় বসবাস করছে।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শয়ন শীল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর এর প্রতিবাদে জুম্ম–ছাত্র জনতার ব্যানারে ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে অবরোধ ডাকা হয়। পরদিন থেকে তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধের ডাক দেয় সংগঠনটি। অবরোধের মধ্যেই ২৮ সেপ্টেম্বর গুইমারার রামেসু বাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে তিনজন নিহত হন।

রামেসু এলাকার এক ভিক্ষু বলেন, ‘প্রবারণা পূর্ণিমা আমাদের আত্মশুদ্ধির দিন। মানুষ এই দিনে পাপক্ষালনের মাধ্যমে নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়। কিন্তু এবারের প্রবারণায় কেউ আনন্দ করতে পারছে না। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।’

খাগড়াছড়ি পৌর শহরের পুরোনো বিহারেও এবার আগের বছরের মতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হচ্ছে না প্রবারণা পূর্ণিমা। য়ংড বৌদ্ধ বিহারের নানা আয়োজন থাকলেও কল্পজাহাজ ভাসানো হবে না। কল্পজাহাজ তৈরির জন্য বরাদ্দ অর্থ গুইমারার রামেসু এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে দেওয়া হয়েছে।