মৌলভীবাজারে শাপলাপাতায় ঢেকেছে হাওরের জলের শরীর
‘এখানে নাহিকো কাজ—উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা’—এ রকম স্থানটি তখন কোনো এক অবসরের মায়াবী মুহূর্ত হয়ে ওঠে। এই স্থান একটি হাওরের এক প্রান্ত, একটি দিক; যেখানে তখন বিকেলের রোদে শেষবেলার স্নান সারছে শাপলাপাতার দল। পাতার বিশাল সবুজ চাদরের ওপর টলমলে-ছলছল করা জলের বুকে ধাতব হাসির মতো চকচক করছে রুপালি তরল রোদ।
মৌলভীবাজারের রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়ক সব সময়েই প্রকৃতির মতো করে নিজেকে বদলে নিতে পারে, ভিন্ন ভিন্নভাবে ভালো লাগার একটি পথ এটি। সড়কের দুই পাশে বারো মাসই কমবেশি বুনো জলজ ফুলের দেখা পাওয়া যায়, জলজ গাছ তো আছেই। পথটি গ্রাম পেরিয়ে যখন খোলা প্রান্তরে ঢুকে যায়, তার দুই পাশে বুক মেলে থাকে কাউয়াদীঘি হাওর, হাওরের অবারিত জল, জলভাঙা ভূমি।
কখনো থইথই করা জল নাচে, কখনো সবুজ-সোনালি ধানের খেত বহুদূর ছড়িয়ে থাকে। এখন তো জলের সময়, মাত্র বর্ষা গেছে। সেই জলের শরীর ঢাকা পড়েছে শাপলাপাতায়। যত দূর চোখ যায়, যেন সে এক শাপলাপাতারই সাম্রাজ্য। এই পাতাদের ভিড়ে মাঝেমধ্যে দু–চারটি করে সাদা শাপলা ফুল ফুটে আছে। তারা যেন পড়শির মতো, লেপটে থাকে পাতার শরীরে।
সম্প্রতি এক বিকেলে তখন কাউয়াদীঘি হাওরের ওই শাপলার জলজ বনে শেষবেলার রোদ পড়েছে। সূর্যটা ফিরছে কোথাও। সন্ধ্যা আসছে। চারদিকে সন্ধ্যা আসার শান্ত স্তব্ধতা, ছায়া বাড়ছে। দু–একটি পানকৌড়ি, দু–একটি শঙ্খচিল হাওরের ওপর দিয়ে উড়ছে। কখনো, ‘হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে’। নানা রঙের একদল গৃহী হাঁস শেষবেলার সাঁতার কাটছে হাওরের জলে, তাদেরও তো ঘর আছে। তারাও একটু পর বাড়ি ফিরবে।
রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কের বড় একটা অংশ কাউয়াদীঘি হাওরের ভেতর দিয়ে গেছে। এই সড়ক গেছে রাজনগর উপজেলা সদর থেকে উত্তর দিকে। মিশেছে কুশিয়ারা নদীপাড়ের বালাগঞ্জ খেয়াঘাটের সঙ্গে। সড়কের দুই পাশে গভীর আনন্দ হয়ে ভেসে আছে এখন শাপলাপাতা। যত দূর চোখ যায়, শুধু শাপলাপাতার সাম্রাজ্য ছড়ানো। শাপলাপাতার সবুজ চাদরে ঢাকা পড়ে আছে জল, জলের শরীর। কোথাও টলটলে জলের ওপর সবুজ গোল থালার মতো ভাসছে পাতারা। যেন এখনই কেউ সেই থালার পাতে কিছু একটা তুলে দেবে।
কোথাও পাতার ওপর ছলকে পড়া রোদ তরল রুপার মতো মিশে আছে। এত ঘন পাতার ভিড়, জলের শ্বাস নেওয়ারও যেন ফাঁক নেই। এই শাপলাপাতা ঠেলে কেউ নৌকা নিয়ে বেরিয়েছেন মাছ ধরতে। বাড়ির সড়কপথ পানিতে তলিয়ে থাকায় কেউ রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়ক থেকে নৌকা দিয়ে বাড়ি ফিরছেন। হাওরপাড়ে শাপলাপাতারা এখন আলাদা করে চোখে পড়ার মতো। জলজঙ্গলে শুধুই এখন শাপলাপাতার সাজানো সংসার। সঙ্গে কিছু জলজ ঘাস, জলজ উদ্ভিদ, শালুক-লতা মিলেমিশে আছে।
শিক্ষক ও সংগঠক আবদুল আজিজ জানান, জলের এই শাপলাবনে সাদা ফুলই বেশি ফোটে। সকালের দিকেই ফুলের দেখা মেলে বেশি। দুপুর পর্যন্ত কিছুটা ফুল দেখা যায়। এরপর ফুল কমে আসতে থাকে। বিকেল থেকে আবার ফুলের পাপড়ি মেলা শুরু হয়।
হাওরপারের বেতহুঞ্জা গ্রামের একজন গৃহিণী তাঁর বাড়ির কাছের শাপলাপাতার ঝাড় দেখিয়ে সে কথাই শোনালেন, ‘সকালে ফুল বেশি থাকে।’
তবে তখনো ফুটে থাকা কিছু ফুল হাওয়ায় দুলছে। দূর থেকে মনে হয় জলের বুকে সাদা সাদা রঙের ফোঁটা ভেসে আছে। রুপালি রোদের সঙ্গে সাদা ফুল অনেকটা মিশে গেছে। হয়তো এ জন্য দিনের বেলা ফুল ততটা চোখে পড়ে না। রোদ বাড়লে শাপলা ফুল পাপড়ি গুটিয়ে নেয়। তখন অনেক কলিই ঠোঁট বুজে আছে। রাত হলে তারা ঘোমটা খুলবে। সকালের মিঠে-কড়া রোদে স্নান সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়বে।
স্থানীয় লোকজন জানান, এ সময়েই বেশি শাপলা হয়ে থাকে। ভাদ্র-আশ্বিনেই বেশি শাপলার ফুল ফোটে। কাউয়াদীঘি হাওরে সাদা শাপলাই বেশি। বাড়ির পুকরে, বাড়ির কাছের ডোবায় হঠাৎ কিছু লাল শাপলার দেখা মেলে। মাঝেমধ্যে ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ফুলগুলো ভাসছে। হাওরের গভীরের দিকেও এখন সাদা শাপলা ফুল ফুটেছে।
তখন বিকেলটা পাতার শরীরে মিশতে শুরু করেছে। ধীরে সন্ধ্যা নামছে। জাল গুটিয়ে, নৌকা ভিড়িয়ে অনেকেই বাড়ির পথ ধরেছেন। শাপলাপাতারা, শাপলার ফুল শান্ত-শীতল রাতের বুকে আবার তাজা হয়ে উঠবে, নিজেদের গোটানো শরীর মেলতে শুরু করবে।